রামানুজ চরিত
প্রথম অধ্যায়- দ্বিতীয় পর্ব
(৫)
প্রতিকার:
শুক্লপক্ষের চন্দ্রের ন্যায় রামানাজের প্রতিভা দিন দিন যতই বাড়িতে লাগিল, যাদবের সঙ্গে তাঁহার মতভেদও ততই প্রবল হইয়া উঠিতেছিল। রামানন্দজের রূপে, ময়ূর চরিত্র ও গভীর শাস্ত্রজ্ঞানের নিকট যাদবের ভক্তিহীন পান্ডিত্যের গৌরব যে অচিরেই ম্লান হইয়া পড়িবে, সেই বিষয়ে আর সন্দেহ রহিল না। তখন যাদবের অন্তরের পশ, জাগিয়া উঠিল, রামানাজের অস্তিত্ব তাঁহার অসহনীয় বোধ হইতে লাগিল। বিষম মর্মবেদনায় কাতর হইয়া, তিনি একদিন তাঁহার অন্তরা শিষ্যগণের সহিত পরামর্শ করিতে বসিলেন। তিনি শিষ্যগণকে বুঝাইলেন, “ভগবান শঙ্করাচার্য' শিবের অবতার, তিনি যে ধর্ম- মত প্রচার করিয়াছেন, তাহা ব্যতীত মানুষের কল্যাণের আর কোনও উত্তম উপায় নাই। কিন্তু রামানন্দজ আচার্যদেবকে মানে না, তাঁহার মতের নিন্দা করে, পরন্তু শাস্ত্রের নানারূপে কদর্থ করে। সে হয়তো ভবিষ্যতে আচার্য -মতের বিরোধী নতন মত প্রচার করিয়া মানুষের অত্যন্ত অমঙ্গল করিবে । আর যাদব মরিয়া গেলে, রামানাজের মতো প্রতিভাশালী লোকের সঙ্গে তর্ক বিচার করিয়া, আচার্যে'র মত রক্ষা করা খুবই কঠিন হইবে...... ইত্যাদি।
গুরুদেবের সহিত একমত হইয়া শিষ্যগণ অনেক আলোচনা করিয়া স্থির করিল, রামান,জকে হত্যা করা ছাড়া আচার্যদেবের মত রক্ষার অন্য কোনও উপায় নাই ; আর, বহ, লোকের কল্যাণের জন্য এক ব্যক্তিকে হত্যা করিলে পাপও হয় না; ভগবানের অবতারগণের জীবনে ইহার সস্পষ্ট প্রমাণ রহিয়াছে। কিন্তু, আর একটি সমস্যা দাঁড়াইল এই যে, এই লোকটা কাঞ্চী- নগরে বড়ই বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছে ; ইহাকে হত্যা করা সহজ ব্যাপার নহে। তখন, আবার অনেক গবেষণার পর সিদ্ধান্ত হইল, শিষ্যগণ গরুর সঙ্গে দল বাঁধিয়া তীর্থদর্শনে বাহির হইবে এবং পথে সুযোগ অনুসারে রামানুজেকে হত্যা করিবে ; তারপর কাশীধামে গিয়া গঙ্গাস্নান করিলেই ব্রহ্মহত্যার পাপ পরে হইয়া যাইবে।
চমৎকার ব্যবস্থা বটে! পাপপূণ্য কিসে হয় বা না হয়, সাধারণ লোকের পক্ষে বুঝা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং কতকগুলি শ্রুতি-মনোহর যুক্তি দাঁড় করাইতে পারিলে, পূণ্যের নাম করিয়া, মানুষকে দিয়া সকল প্রকার ে করানো সম্ভব হয়। ধর্মের ভাঁওতায় জগতে কতই না হত্যা, অবিচার, অত্যাচার হইয়া থাকে! আর, মানুষ হজেগে বড় ভালবাসে; দৃষ্ট,দ্ধি অসুরগণ তাহাদের এই দুর্বলতার সুযোগ চিরকাল 'জিয়া বেড়ায়।
(৬)
ধর্মের ভান:
যাদবের বহু কাল বিস্মত ধর্মভাব হঠাৎ যেন জাগিয়া উঠিল। তিনি মাঘ মাসে প্রয়াগে কল্পবাস করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। অনুগত শিষ্যগণ গল্পের সঙ্গে তীর্থযাত্রার এই শুভ সংযোগ পাইয়া কৃতার্থ হইল। তাহারা রামানুজকে কৃত্রিম ভালবাসা দেখাইয়া তাহাদের সঙ্গে বাইতে সম্মত করাইল। রামানাজের মাসতুত ভাই গোবিন্দও তাহাদের সঙ্গে যোগদান করিল।
তখনকার দিনে, পায়ে হাঁটিয়া তীর্থে যাইতে হইত। কয়েক দিন চলিবার পর, যাহিদল বিন্ধ্য পর্বতের নিকট গোড়ারণ্য নামক ভীষণ বনে প্রবেশ করিল। সরলমতি গোবিন্দ একদিন শুনিতে পাইল, সতীর্থগণ রামানুজকে ফেলিবার পরামর্শ করিতেছে। কোনও সূর্যোগে সে রামানজেকে এই কথা জানাইল। আর কোনও উপায় নাই দেখিয়া রামানুজে অগত্যা খুব নিবিড় বনের ভিতর পলায়ন করিলেন। যাদবের দল তাঁহাকে দেখিতে না পাইয়া চিন্তিত হইল, দঃখের ভান করিয়া অনেক খোঁজাখ, 'জি করিতে লাগিল কিন্তু এই ভীষণ অরণ্য মধ্যে পলাইবার কোনও পথ দেখিতে পাওয়া গেল না। তখন তাহারা এই ভাবিয়া নিশ্চিন্ত হইল যে, কোনও হিংস্র জন্তু নিশ্চয়-ই
রামানজেকে টানিয়া লইয়া গিয়াছে। রামানুজে সভ্য জন্তুর হাত হইতে রক্ষা পাইলেন বটে, কিন্তু বন্য জন্তু হইতে অব্যাহতি লাভের কোনও পথ দেখিতে পাইলেন না; যতই অগ্রসর হইতে লাগিলেন, নিবিড় হইতে নিবিড়তর অরণাই কেবল দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। তিনি ভগবানকে স্মরণ করিয়া যথাসাধ্য সম্মুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এইরূপে চলিতে চলিতে ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর ও পথশ্রমে ক্লান্ত হইয়া যখন একান্ত হতাশ হইয়া পড়িলেন, তখন তিনি সহসা দেখিতে পাইলেন, এক ব্যাধ সেই গভীর অরণ্যে শিকার জিয়া বেড়াইতেছে। উভয়ে উভয়কে দেখিয়া অবাক্ । এমন সন্দের পুরুষের এই দুর্দশা দেখিয়া, ব্যাধের মনে দয়া হইল। সে এক অতি সংক্ষিপ্ত বন্যপথে তাঁহাকে লইয়া গিয়া, কাজী- নগরে পৌঁছাইয়া দিল। এত শীঘ্র রামানজেকে একাকী ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া সকলেই কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। রামানুজে বলিলেন, গোল্ডারণ্যের নিবিড় বনে পথ হারাইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে, অবশেষে এই কাঞ্চীতে আসিয়া পড়িয়াছেন।
(৭)
"সম: শত মিত্রে চ তথা মানা পমানয়োঃ":
তীর্থদর্শনের অভিনয় করিয়া যাদব যথাকালে দেশে ফিরিয়া জানিলেন, রামানন্দজ পথ হারাইয়া তাঁহার পূর্বেই দেশে ফিরিয়া আসিয়াছেন। কী ভয়ঙ্কর কথা! সংবাদটি শেলের ন্যায় তাঁহার বুকে বাজিল। তিনি এবং তাঁহার শিযাগণ অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রামানুজে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া পূর্বের ন্যায় যথোচিত শ্রদ্ধাভক্তি প্রদর্শন করিলেন। যাদব ভাবিলেন, “রামান জেটা তো একেবারেই বোকা, সতরাং আমার মতো চতুর লোকের মনোভাব সে বুঝিতে পারিবে কেন ? তিনি নিশ্চিন্ত রহিলেন।
দুষ্টামিটা ভালরূপে চাপা দিবার জনাই হউক, অথবা রামানন্দজকে সংহার করিবার নতেন পথ বাহির করিবার জন্যই হউক, যাদব খুব আদর করিয়া, পাঠ আরম্ভ করিবার জন্য রামান,জকে অননুরোধ করিলেন। রামাজে, অম্লান বদনে, প্রশান্ত চিত্তে, আবার টোলে যাতায়াত আরম্ভ করিলেন। রামানুজের মন যে কত নির্মল ছিল, তাহা আমরা কল্পনাও করিতে পারি না। কেহ একটা কট, কথা বলিলে, আমরা তাহা সারা জীবন ভুলিতে পারি না, প্রাণান্তকর শত্রুকে ক্ষমা করা তো দূরের কথা। শাস্ত্রে লিখিত আছে, ভগবানে ভক্তি হইলে শত্রু-মিত্র জ্ঞান থাকে না, সকল জীবকে সুহৃৎ বলিয়া মনে হয় ; আর, ভক্তিহীন মানুষে আর পশ্চাতে বিশেষ তফাৎ নাই ; কারণ, স্বার্থে আঘাত লাগিলে উভয়ই নির্মম ও হিংস্র হইয়া উঠে ভক্তিহীন লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি হইলে, সমাজে মহা অশান্তি উপস্থিত হয়; তখন, রামানুজের ন্যায় মহাপরুষগণ জন্ম গ্রহণ করিয়া মানুষকে সুখে-শান্তি লাভের পথ প্রদর্শন করেন।
আলো অন্ধকার এক স্থানে থাকিতে পারে না। যাদবের সহিত রামানাজের মতবিরোধ অল্পকাল মধ্যেই আবার প্রকাশিত হইল। ভগ্নি ছাড়িয়া, শাস্ত্রের কথা নিয়া, কেবল চলে-চেরা বিচার, রামানুজের মোটেই ভাল লাগল না। যাদবও রামানাজের ভগবতীর একেবারেই সহ্য করিতে পারিলেন না। তাঁহার হৃদয়ের গণপ্ত বিষ আবার ব্যক্ত হইল; তিনি, রামানন্দজকে অপমানিত করিয়া, তাঁহার আশ্রম হইতে তাড়াইয়া দিলেন।
(৮)
আদর্শ:
বর্তমান সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অবধি নাই। কিন্তু চরিত্র কিরপে মহৎ হয়, মন কিরূপে শান্ত হয়, এই সব দিকে মানুষের দৃষ্টি অত্যন্ত কম। রামানুজের সময়েও সমাজের অবস্থা এইরূপে-ই হইয়াছিল। তখন যাদবের মতো নরপশ,ও সাধ্য-সমাজে উচ্চস্থান পাইত এবং শাস্যজ্ঞের গৌরবে সম্মানিত হইত। বিপথগামী সমাজকে যিনি পথ প্রদর্শন করিতে আসিয়াছেন, সমাজের কোথায় কিরূপ ব্যাধি, ইহা তাঁহার ভালর পেই জানা আবশ্যক। তাই বুঝি ভগবানের ইচ্ছায়, রামানুজের মনে শাস্ত্রজ্ঞান লাভের এইরূপে অদমনীয় আকাঙ্ক্ষা এবং এই সূত্রে যাদবের সহিত তাঁহার মিলন। যাদবের চরিত্রে তিনি সাধনহীন শাদাজ্ঞানের ব্যর্থতার ও ভক্তিহীন মানুষের পশ্চত্ব প্রাপ্তির চরম নিদর্শন দেখিতে পাইলেন।
এই কঠিন আঘাতে রামানাজের শাস্ত্রজ্ঞান লাভের মোহ কাটিয়া গেল। আজ বড় রাখিত হৃদয়ে, শান্তিলাভের জন্য, তিনি কান্য পেের্ণর নিকট ছাটিয়া গেলেন। বাল্যকাল হইতেই, তিনি ইহাকে বে ভক্তি করিতেন। তাঁহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, কাঞ্চীর্ণের সঙ্গে শ্রীবরদরাজ কথা বলেন। তাই ধর্ম বিষয়ে কোনও সংশয় উপস্থিত হইলেই, তিনি বরদরাজের মত জানিবার জন্য কাঞ্চীপ,র্ণের নিকট যাইতেন। কাঞ্চীপূর্ণ ও এই মেধাবী, অত্যন্ত সরল এবং ভগবদ তত্ত্ব ব্রাহ্মণ কে খুব ভালবাসিতেন।
শাস্ত্রচর্চার মোহঘোরে, যাদবের সঙ্গে, রামানুজের এতকাল কাি গিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয়, যানব-চরিত্রের সমালোচনা এতদিন তাঁহার মনে একবারও উঠে নাই। কিন্তু আজ যেন আপনা হইতেই, যাদব ও কাঞ্চীপূর্ণ এই উভয় চরিত্রের দুইটি ভিন্ন চিত্র তাঁহার নয়নের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল। একদিকে, অসামান্য প্রতিভাবান, পণ্ডিত, রাজা হইতেও অধিক সম্মানিত, কিন্তু মান-যশের কাঙ্গাল, হিংসা-শেষ প্রভৃতি হীন মনোবৃত্তির দাস, ঈশ্বরে ভক্তিহীন,—সেইজন্য, অন্তরে অবলম্বনহীন শকহৃদয় যাদব। অন্যদিকে, নীচ জাতীয়, মূর্খ, বাহা দৃষ্টিতে দীনহীন, কিন্তু ভগবৎ-শক্তিতে অসীম শক্তিমান এবং সকল প্রকার নীচতা, হীনতা ও দঃখ-বেদনার ঊর্ধ্বে অবস্থিত কাঞ্চীপূর্ণ।
যাদবের সকল গৌরব তাঁহার নিকট আজ একান্ত ম্লান, তুচ্ছ, হেয় ও আকর্ষণহীন বোধ হইতে লাগিল। তাঁহার মনে হইল, যাদব কেবল কথার বোঝা' বহিয়া জীবন বৃথা ক্ষয় করিতেছেন, আর কাশ্মীপূর্ণে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ভগবদ্ভক্তি লাভ করিয়া ধন্য হইয়াছেন। তিনি দেখিলেন, কাশ্মীপূর্ণের জীবনের মহান আদর্শে তাঁহার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে, সেখানে অন্য আদর্শের আর স্থান নাই। ভগবান লাভ ব্যতীত মানবজীবনের আর অন্য উদ্দেশ্য হইতেই পারে না, ইহা সম্পদই তিনি আজ বুঝিতে পারিলেন।
কাশ্মীপূর্ণের পরে সলো, এই দশচিত ভন্তিকোমল হৃদয়ের গ্লানি দূর হইতে বেশি সময় লাগিল না। রামানজে যখন যে বিষয়ে মন দিতেন, তখন তাহাতেই তন্ময় হইয়া যাইতেন। পূর্বে যেমন পাঠে তন্ময় ছিলেন, এখন ভগবানের চিন্তায় তেমনই ডুবিয়া গেলেন ।
ইহার কিছুদিন পরে, তাঁহার মাতা ইহলোক ত্যাগ করেন।