রামামুজ চরিত
প্রথম অধ্যায়- প্রথম পর্ব ( ১-৪)
(১)
বাল্য:
যে সকল মহাপুরুষের চরিত্র প্রভাবে ভারতের জাতীয় জীবন গড়িয়া উঠিয়াছে, আচার্য রামানাজ তাঁহাদের অন্যতম । এস নবযুগের তরুগণ, এই বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের দিনে, সেই মহাপুরুষের অতি মনোহর ও শিক্ষাপ্রদ জীবন কথা আমরা আজ একবার স্মরণ করি।
এক হাজার বৎসর পূর্বের কথা। মাদ্রাজ শহর হইতে প্রায় ২৮ মাইল দূরে, শ্রীপেরেমবন্দরে নামক প্রসিদ্ধ গ্রামে, সদাচার-সম্পন্ন অনেক ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। তথায় কেশব দীক্ষিত নামে জনৈক শাস্ত্রজ্ঞ ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি সর্বদা যাগযজ্ঞ করিতেন, তাই লোকে তাঁহাকে 'সর্বকুতু’* এই উপনাম দিয়াছিল। পরম বৈষ্ণব শ্রীশৈলপূর্ণের ভগিনী কান্তিমতীকে তিনি বিবাহ করেন। কান্তিমতীর গর্ভে, ১০১৭ খৃস্টাব্দে আচার্য রামানন্দজ জন্ম গ্রহণ করেন।
বালক রামানুজে যেমন সুশ্রী, তেমনই সংস্থ ও সবল ছিলেন। তাঁহার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ; যাহা একবার শানিতেন, তাহা আর জ্বলিতেন না। তাঁহার মধুর ও নম্র ব্যবহারে সকলেই মুগ্ধ হইত। উপনয়নের পর, পণ্ডিত কেশব নিজেই তাঁহাকে বেদ ও বেদাঙ্গ পড়াইতে লাগিলেন। মেধাবী শিশ, অল্প কালেই অনেক বিষয় শিক্ষা করিলেন। পরন্তু, পিতৃকূল ও মাতৃকালের সহ-দৃষ্টান্ত অনুকরণে, তিনি বাল্যকাল হইতেই ভাবক, প্রেমিক ও ভক্ত হইয়া উঠিতে লাগিলেন। কাশীর বিশ্বনাথ ও পুরীর জগন্নাথ দেবের ন্যায় কাজীপুরের শ্রীবরদরাজ নামক বিষ্ণুমূর্তি বড়ই জাগ্রত দেবতা। পেরেমবদের গ্রামের নিকটবর্তী পদ্মনামেলি গ্রামের কাঞ্চীপূর্ণ বরদরাজের পরম ভক্ত বলিয়া, প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। লোকে বিশ্বাস করিত, বরদরাজ তাঁহার সঙ্গে কথা বলেন। কাঞ্চীপূর্ণ', নিতাই, কেশবের বাটীর সম্মুখে পথ দিয়া, বরদরাজের মন্দিরে যাতায়াত করিতেন। বালক রামাজে এই মহাপুরুষের সঙ্গে ভাব করিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহাকে বাড়িতে ডাকিয়া আনিয়া সেবাযত্ন করিতেন এবং তাহার মুখে ভগবানের কথা শুনিয়া আনন্দিত হইতেন।
ষোল বৎসর বয়সে রামানাজের বিবাহ হয়। বিবাহের অল্প কাল পরে কেশব সহসা দেহ ত্যাগ করেন। এই ঘটনায় রামানজে ও তাঁহার মাতা কান্তি মতী অত্যন্ত শোকার্ত হইয়া পড়েন। কেশবের স্মৃতি-বিজড়িত পেরেম- বন্দরে গ্রাম ত্যাগ করিলে হয়তো তাঁহার অভাব বোধ কিছু হ্রাস পাইতে পারে, এই ভাবিয়া মাতা, পত্র ও পুত্রবধূকে লইয়া, কাঞ্চীনগরে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন।
এই সময়ে, যাদব প্রকাশ * নামক জনৈক বিখ্যাত পণ্ডিত-সন্ন্যাসী কান্তী- পরে বেদান্তাদি নানা শাস্ত্র অধ্যাপনা করিতেন। রামানাজ তাঁহার নিকট পড়িতে আরম্ভ করিলেন। কিছুদিন পরে, রামানাজের মাসতুত ভাই গোবিন্দ আসিয়া তাঁহাদের সঙ্গে বাস করিতে লাগিল এবং যাদবের টোলে ভর্তি হইল।
(২)
সমাজ:
তদানীন্তনের লোক প্রচলিত সামাজিক নিয়ম ও ধর্ম সম্বন্ধে অত্যন্ত গোঁড়া ছিলেন। ভারতের ঐ অঞ্চলেও তখন সামাজিক রীতি-নীতিতে ব কঠিন গোঁড়ামি থাকায় ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণের মধ্যে আচারে ব্যবহারে ও মেলা- মেশাতে ঘোরতর অমিল ছিল। শৈব ও বৈষ্ণবগণের মধ্যে বেষাদ্বেষী ভাব তখন চরমে উঠিয়াছিল। রামাজে যখন যাদবের টোলে পড়িতেছিলেন, তখন কাঞ্চীতে শৈবগণ পণ্ডিত-সন্ন্যাসী যাদব প্রকাশের অধীনে প্রবল হইয়া উঠেন। সতরাং সেখানে বৈষ্ণবগণ সঙ্কাচিত হইয়া বাস করিতেন। আবার, শ্রীরাম নগরে, মহা- পণ্ডিত ও ত্যাগী সিদ্ধপুরুষ যাম,নাচার্যের প্রভাবে, বৈষ্ণবগণ গৌরবান্বিত ও শৈবগণ দুর্বল ছিলেন।
(৩)
গরু-শিষ্য:
স্বামী যাদব প্রকাশ কান্ত পরে সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। রামানুজে উৎসাহের সহিত তাঁহার নিকট বেদান্ত পাঠ আরম্ভ করিলেন এবং সফরে বেরে সেবা করিয়া তাঁহার প্রিয়পার হইয়া উঠিলেন। মেধাবী ছাত্র পাইলে গুদের উৎসাহ বাড়ে ; বিশেষতঃ রামানাজের ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন ছাত্র দুর্লভ। সুতরাং স্বামীজীও হবে উৎসাহের সহিত ছাত্রটিকে শিক্ষা দিতে লাগিলেন। রামানুজের এক আত্মীয়-তনয় সরলবৃদ্ধি গোবিন্দও তাঁহার নিকট পড়িতে লাগিল। গোবিন্দ রামানজেকে প্রাণাধিক ভালবাসিতেন।
কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষকের এই ভালবাসায় একটি মহা বিদ্য উপস্থিত হইল। রামানুজে বুদ্ধিমান ও ভক্ত ; আর, যাদব ভক্তিহীন ও তার্কিক। যাদব ভগবানের মহিমা ও মাধষ দঝিতে পারিতেন না। তিনি রামানাজের ভগবদ ভক্তি নিতান্ত বোকামি মনে করিতেন এবং তাঁহাকে শুষ্ক জ্ঞান বিচারের পথে আনিবার চেষ্টা করিতেন। ইহাতে রামানুজে বড়ই উত্তাপ্ত হইতেন।
একদিন রামানুজে যাদবের গায়ে তৈল মাখাইতে ছিলেন এবং যাদব একটি শিষ্যকে উপনিষদের একটি বাক্য বুঝাইতে ছিলেন। ঐ বাক্যে বলা হইয়াছে, নারায়ণের চোখ দুইটি পদ্মের ন্যায়, আর ঐ পদ্ম কপ্যাসের ন্যায়। যাদব বলিলেন, কপি শব্দে বানর বুঝায় এবং আস শব্দের অর্থ নিতম্ব। সুতরাং কপ্যাস শব্দের অর্থ, বানরের পশ্চাদ ভাগ। নারায়ণের চক্ষু, দুইটি বুঝাইবার জন্য, জগতের সব ভাল ভাল বস্তু ছাড়িয়া, বানরের নিতম্বের উপমা দেওয়াতে, রামানুজে বড়ই বাধিত হইলেন; এমন কি, তিনি অশ্রু সংবরণ করিতে পারিলেন না। হৃদয়হীন কে যাদব, রামানুজেকে কাঁদিতে দেখি খুব বিরক্ত হইয়া বলিলেন, "আচার্য শঙ্কর এইরূপে অর্থ করিয়াছেন, ইহা তো আমি কল্পনা করিয়া বলিতেছি না।" রামানুজে বলিলেন, "আচার্যদেব ইচ্ছা করিলে, ইহার সদর্থও করিতে পারিতেন।" এই কথায় যাদব আরও রাগিয়া বলিলেন, “ইহা যদি কদর্থ, তবে সদর্থটা কি হইতে পারে তুমি-ই বল। রামাজে বলিলেন, "আপনার আশীর্বাদে, ইহার সন্দের অর্থও হইতে পারে। ক অর্থ জল, তাহা যিনি পান বা শোষণ করেন তিনি কপি, অর্থাৎ সূর্য। আস শব্দ বিকশিতও বুঝায়। সুতরাং কপ্যাস শব্দের অর্থ সূর্য বারা বিকশিত।
এই অর্থ খুব সুন্দর হইল বটে, কিন্তু যাদব ইহাতে মুখ হইতে পারিলেন না। তাহার ব্যাখ্যার নিন্দা করিয়া নতনভাবে এমন সন্দের অর্থ করাতে, অহঙ্কারী পণ্ডিতের মন অভিমানে ও ঈর্ষায় জ্বলিতে লাগিল।
(8)
অনলে ঘৃতাহুতি:
যাদবের অভিমানে আঘাত লাগিবার আর একটি গরতের কারণ উপস্থিত হইল। কাঞ্চীপুরের রাজকন্যার দেহে এক ব্রহ্মদৈত্যের আবেশ হয়। অনেক চিকিৎসাতেও মেয়েটি সংস্থ হইল না। সাধু-সন্ন্যাসী দেখিলে জুতে পালায়। বিশেষতঃ যাদব মন্ত্র-তন্ত্রও জানিতেন। তাই রাজা মেয়েটির চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে আহ্বান করিলেন। যাদব অনেক শিষ্য সহ, বেশ আড়ম্বরের সহিত, রাজবাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু ব্রহ্মদৈত্য যাদবের ভুকতাক, ঝাড়-ফাক সবই হাসিয়া উড়াইয়া দিয়া তাঁহাকে পবে উপহাস করিতে লাগিল। শিষ্যদের সঙ্গে রামানজেও উপস্থিত ছিলেন। দৈত্য তাঁহাকে দেখাইয়া বলিল, “যদি এই ব্রাহ্মণ আমার মাথায় পা দেন, তবে আমি রাজকন্যাকে ছাড়িয়া চলিয়া যাইব।" গুরুর আদেশে রামানজে মেয়েটির মাথায় পা দিলে সে সত্য সত্যই সংস্থ হইয়া উঠিল। রামানাজের এই আশ্চর্য প্রভাব দেখিয়া সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতে লাগিল। গর্, ও শিষ্য উভয়কে রাজা অনেক ধনরত্ন দিলেন। রামানজে নিজে কিছুই গ্রহণ করিলেন না; সমদেয় গুরে চরণে অর্পণ করিলেন। কিন্তু গরু তুষ্ট হইলেন না, ঈর্ষার অনল তাঁহার হৃদয়ে আরও প্রবল হইয়া উঠিল।