রামামুজ চরিত
তৃতীয় অধ্যায়- প্রথম পর্ব ( ১-৪)
শ্রীরঙ্গমে
আচার্য রামানাজের গৌরবে বৈষ্ণবসমাজ উজ্জল হইয়া উঠিলেন। সাধন- হীন শৈব দলপতিগণ ভীত হইলেন। যান মুনির তপঃ-প্রভাবে, তখন শ্রীরঙ্গম ছিল বৈষ্ণবদের প্রধান কেন্দ্র। মানির শিষ্যগণ, রামানাজকে শ্রীরঙ্গমে লইয়া আসিবার জল্পনা কল্পনা করিতে লাগিলেন। বররঙ্গ গায়ক ও সুবক্তা ছিলেন। ভগবানের স্তুতিগানে এবং মধর প্ররোচনা-বাক্যে তুষ্ট করিয়া রামান,জকে আসিতে সম্মত করিতে পারিবেন ভাবিয়া, বৈষ্ণব নেতৃগণ তাঁহাকে কাঞ্চীপারে প্রেরণ করিলেন। গুরু, মহাপূর্ণ ও গরু,স্থানীয় অন্যান্য মহাপরষদের অভিপ্রায় জানিয়া, রামানাজে শ্রীরঙ্গমে চলিয়া গেলেন। বৈষ্ণব- সমাজ তাঁহার হাতে শ্রীরঙ্গনাথের সেবা ও সমাজ-রক্ষার ভার অর্পণ করিয়া কৃতার্থ হইলেন।
বৈষ্ণবসমাজের উপর একাধিপত্য লাভ করিয়া, তিনি নিজের গুরুদায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হইলেন। এই সমাজের আচার ও নীতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিবার জন্য, তিনি যাম,নাচার্যের শিষ্যদের নিকট, প্রাচীন মহা- পুরুষদের রচিত শাস্ত্রাদি পাঠ ও সাধনা শিক্ষা করিতে লাগিলেন।
(২)
গোবিন্দের বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ
রামানাজের মাসতুত ভাই গোবিন্দ অত্যন্ত সরল ছিলেন। তিনি যাদবের নিকট শাস্ত্র পাঠ করিতেন। কিন্তু অধ্যয়ন অপেক্ষা সাধন ভজনে তাঁহার অনুরাগ ছিল বেশি। যাদবের সঙ্গে তীর্থভ্রমণ করিয়া আসিয়া, তিনি আর পড়িলেন না শ্রীশৈলের নিকটবর্তী এক শৈবপ্রধান স্থানে, শিবলিঙ্গা স্থাপন করিয়া, তাঁহার সেবায় মনপ্রাণ নিয়োজিত করিলেন।
রামানুজে শ্রীরঙ্গমে যাইয়া, ভাই গোবিন্দকে নিজ সম্প্রদায়ে আনিবার জন্য, মাতুল শৈলপ‚র্ণকে অনুরোধ করিয়া, এক পত্র লিখিলেন। শৈলপূর্ণ গোবিন্দের সাধনস্থান মঙ্গল গ্রামে যাইয়া এক সরোবর তীরে বটগাছের তলায় বসিয়া, সমাগত জনগণের নিকট বৈষ্ণবধর্ম ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন। কয়েক দিন পরে, গোবিন্দের দৃষ্টি সেইদিকে আকৃষ্ট হইল। তিনি, অন্যান্য লোকের ন্যায়, শৈলপ,র্ণের ধর্ম কথা শুনিতে, মধ্যে মধ্যে বটতলায় যাইয়া বসিতে লাগিলেন এবং তর্ক-বিতর্কেও কিছু কিছু, যোগ দিলেন। রুমে রুমে, শৈল- পূর্ণের অপূর্ব ব্যাখ্যান, মধুর ভাষা ও বিনীত ব্যবহারে গোবিন্দের মন টলিল। তিনি শৈলপ,র্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া, বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হইলেন। বলা বাহ,লা, এই সংবাদ পাইয়া রামানন্দজ অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন।
(৩)
কুরেশ
করেশের নাম জানা যায় না। তিনি করে গ্রামের অধিকারী ছিলেন বলিয়া, সকলে তাঁহাকে 'করেশ' বলিত। তাঁহার বাড়িতে ক্ষুধিত হইয়া-যে-ই যাইত, সে-ই খাইতে পাইত। তাঁহার যাহা কিছ, আয় ছিল, সবই তিনি ঐ কাজে ব্যয় করিতেন। সেইজন্য অন্নদাতা বলিয়া তাঁহার খুব খ্যাতি ছিল। রামাজে কাঞ্চী ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলে, করেশের মনে এক নাতন ভাব
উপস্থিত হইল। সমস্ত দিন দান-দক্ষিণা ও নিজের প্রশংসা শ্রবণ কার্যে ব্যস্ত
থাকিলে, ভগবানকে ডাকিবার আর সময় থাকে না। এইরূপে ভাবিতে ভাবিতে,
তাঁহার নিকট, সংসার বিষবৎ বোধ হইতে লাগিল। একদিন তিনি বাড়ি-ঘর
ছাড়িয়া ভিখারীর বেশে শ্রীরঙ্গমে গরুর নিকট যাত্রা করিলেন। স্বামী এইরূপে দারিদ্র্য ব্রত গ্রহণ করাতে, করেশের পতিপরায়ণা স্ত্রী খুবই বিচলিত হইলেন এবং এই কঠিন পথে স্বামীকে একা ছাড়িয়া দিতে পারিলেন না ; তিনি নিজেও স্বামীর অনুগমন করিলেন। যদি কখনও খুব অভাবে পড়েন, তখন কাজে লাগিবে ভাবিয়া, তিনি গোপনে কিছু সোনা সঙ্গে লইলেন। চলিতে চলিতে, তাঁহারা, একদিন এক বনপথে উপস্থিত হইলে ক,রেশ- পত্নী অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িলেন। তাহাতে করেশের মনে সন্দেহ হইল যে, পত্নীর সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনও মূল্যবান বস্তু রহিয়াছে। তাহা না হইলে ভয়ের কি কারণ থাকিতে পারে ? যাহার নিকট অর্থ থাকে, সেই তো চোর-ডাকাত হইতে ভয় পায়। করেশের উপদেশে সোনা ফেলিয়া দেওয়াতে সত্য সত্যই তাঁহার মনে আর কোনও ভয় রহিল না।
করেশ ও তাঁহার পত্নী গুর নিকট যাইয়া, তাহারই অনুসরণে ভিক্ষান্নে জীবনধারণ ও সাধনভজনে কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
(৪)
মহাপুরুষ
ন কাময়েঽহং গতিমীশ্বরাৎ পরাম অষ্টদ্ধির্য, ত্তাপ,নভবং বা। আর্ভিং প্রপদ্যেঽখিলদেহভাজাম্ অন্তঃস্থিতো যেন ভবত্যদঃখাঃ ৷ ভাগবত ৯। ২১।১২
ঈশ্বরের কাছে নাহি অষ্ট সিদ্ধি করি আকিঞ্চন, মাক্তি কিংবা অমরতা, তাতে মোর নাহি প্রয়োজন। সবার অন্তরে পশি, দুঃখ সহি তাহাদের সনে, ‘সবারে করিব সখী' এই একমাত্র আশা মনে।
শ্রীরঙ্গমের নিকটবর্তী গোষ্ঠিপুর গ্রামে, যাম, নাচার্যের শিষ্য গোষ্ঠিপূর্ণে বাস করিতেন। তিনি নারায়ণ মন্ত্রে সিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার সাধন গাণে মন্ত্রে এত শক্তি জাগ্রত হইয়াছিল যে, ইহা গরম,খে শ্রবণ মাত্র শিষ্য অন্তরে ঈশ্বরান - ভর্তি লাভ করিত। সম্পূর্ণ উপযুক্ত বোধ না করিলে, গোষ্ঠিপূর্ণ কাহাকেও এই মন্ত্র শুনাইতেন না। এই মন্ত্র লাভ করিবার জন্য, রামানাজ পরম ভক্তির সহিত গোষ্ঠিপর্ণের নিকট গিয়া প্রার্থনা জানাইলেন। পরে আসিও' বলিয়া তিনি রামানুজকে বিদায় দিলেন। রামানুজে আবার গেলে, আবার এইরূপ বলিয়া নিরস্ত করিলেন। রামানুজে বার বার যাইতে লাগিলেন এবং গোষ্ঠি- পূর্ণ ও তাঁহাকে বার বার ফিরাইয়া দিলেন। ইহাতে রামানাজের মনে সন্দেহ হইল, অবশ্যই তাঁহার মনে কোনও রূপে মলিনতা আছে, তাই, গুরু, তাঁহাকে মন্ত্র গ্রহণের যোগ্য মনে করিতেছেন না। এই ভাবিয়া, তিনি কঠোর তপস্যায় মগ্ন হইলেন; তাঁহার শরীর শীর্ণ হইতে লাগিল; প্রফুল্ল মূখে সকলের নিকট তাহার শাস্ত্রালোচনা বন্ধ হইল।
রামানন্দজের মতো উত্তম অধিকারীকে মন্ত্র না দেওয়াতে, গোষ্ঠিপূর্ণের বিরুদ্ধে নানারূপ সমালোচনা হইতে লাগিল। এমন কি, একদিন জনৈক বৈষ্ণব ক্রুদ্ধ হইয়া গোষ্ঠিপর্ণেকে দুই একটি কটা কথা বলিলেন। কিন্তু গোষ্ঠিপূর্ণে কিছুতেই বিচলিত হইলেন না এবং রামানুজেও অধ্যবসায় ত্যাগ করিলেন না। অষ্টাদশ বার প্রত্যাখ্যাত হইয়াও তিনি আবার গোষ্ঠিপূর্ণের নিকট যাইয়া প্রার্থনা জানাইলেন। এইবার তাঁহার মন গলিল, তিনি রামান, জকে মন্ত্র প্রদান করিলেন এবং দৃঢ়ভাবে বলিয়া দিলেন, অনধিকারীকে এই মন্ত্র দিলে মন্ত্রদাতার ঘোর নরক হইবে।
রামানুজে মন্ত্র শ্রবণ মাত্র এক অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করিলেন। মন্ত্রের এই অদ্ভূত শক্তি দেখিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইলেন। দীক্ষা সম্বন্ধীয় সমদেয় কর্তব্য শেষ হইলে, গরুর নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া, তিনি শ্রীরঙ্গম যাত্রা করিলেন। কিছুদের যাইতে না যাইতে তাঁহার মনে কি এক ভাবের উদয় হইল, তিনি পথে যাহাকে পাইলেন তাহাকেই বলিতে লাগিলেন, “তোমরা আমার সঙ্গে এস, আমি তোমাদিগকে এক অমূল্য রত্ন দিব।” তাঁহাকে সকলে দেবতা জ্ঞান করিত; তাঁহার এই কথা শুনিয়া ক্ষণকাল মধ্যে, নিকট- বর্তী গ্রামের সমস্ত লোক তথায় সমবেত হইল। দক্ষিণ ভারতে দেব-মন্দিরের ফটকের উপর খুব উচ্চ মগ্ন থাকে। রামানুজ সেই গ্রামের এক ঠাকুরবাড়ির ফটকের উপর উঠিয়া সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, "হে ভাই-ভগিনীগণ, আমি তোমাদিগকে একটি মন্ত্র শুনাইব, আমার সঙ্গে ইহা তিন বার উচ্চারণ করিলে, তোমাদের সকল দুঃখ দূর হইবে এবং দেহত্যাগের পর তোমরা বৈকুণ্ঠে যাইবে।” এই কথা বলিয়া, তিনি উচ্চৈঃশ্বরে “ নমো নারায়ণায়" এই মন্ত্রটি তিনবার উচ্চারণ করিলেন। সমবেত জনতাও তাঁহার সলো ইহা আবৃত্তি করিল। শব্দগুলি উচ্চারণ করিবা মাত্র, সকলে বোধ করিল, যেন তাহাদের নিজ নিজ শরীরের বোঝাটি খসিয়া পড়িয়াছে এবং অপূর্ব আনন্দে মন পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। মানুষের নিজের ভিতর যে এত আনন্দ আছে, তাহা তো মানুষ জানে না। রামানন্দজকে সাক্ষাৎ মক্তিদাতা ভগবান, জ্ঞান করিয়া, রহ্মানন্দে ভরপরে হইয়া, সকলে ঘরে ফিরিল।
এদিকে, গোষ্ঠিপূর্ণে এই সংবাদ শানিয়া, ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া, শিষ্যকে ডাকিতে লোক পাঠাইলেন। ক্রোধ হইবারই কথা বটে! থাকে তাকে ম মন্ত্র দিতে এত নিবন্ধ সহকারে তাঁহাকে নিষেধ করিলেন, আর, রামানজে কি-না সদ্য সদ্য, একেবারে হাটে হাঁড়ি ভাঙিয়া, গুহর আদেশ সম্পূর্ণরূপে লঙ্ঘন করিলেন! গুরুদেবের আহান শুনিয়া রামাজে তৎক্ষণাৎ অতি বিনীত- ভাবে, নিঃসঙ্কোচে, গরুর নিকট উপস্থিত হইলেন। গর্, ক্রুদ্ধ হইয়া কতই না ভৎসনা করিলেন এবং দুকার্যের ফলে তাঁহার যে নরক বাস হইবে, এই কথাও বার বার স্মরণ করাইয়া দিতে লাগিলেন। রামানুজে প্রফল্ল মুখে স্থির হইয়া সকল কথা শুনিলেন, তারপর আঁতি বিনীতভাবে বলিতে লাগিলেন, "গুরুদেব, এই সব লোক সংসার বন্ধনে পড়িয়া বড়ই কষ্ট পাইতে- ছিল। আজ এই মধ্য শ্রবণ করিয়া সকলে মুক্তিলাভ করিল। এত লোকের মুক্তির জন্য আমার একজনের নরক-বাস হউক, তাহাতে আমার কোনও দুঃখ নাই।” রামানন্দজের রামানন্দজের করুণা ও গুরু-বাক্যে বিশ্বাসের সহিত স্বাভাবিক তেজম্বিতা মিলিয়া, এমন এক সৌন্দর্যের প্রকাশ হইল যে, গোষ্ঠিপূর্ণের হৃদয় পলিয়া গেল, ক্রোধের স্থলে তাঁহার মনে শ্রদ্ধার উদয় হইল। তিনি রামানুজকে মহাপুরুষ বলিয়া বুঝিতে পারিলেন। পরার্থে সর্ব ত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত এই স্বার্থ-সর্বস্ব মানব জগতে বড়ই দুর্লভ। পূর্ণ নিজ পত্র সৌমাকে রামানুজের শিষ্য করিয়া দিয়া, মহত্ত্বের পূজো করিলেন।
অতঃপর, রামানজে খুব শ্রদ্ধার সহিত মালাধর ও বররঙ্গের সেবা করিয়া তাঁহাদের নিকট শিক্ষালাভ করিলেন। তাঁহার প্রতিভা ও মহত্ত্বে মুগ্ধ হইয়া ইহারাও রামানুজেকে মহাপুরুষ বলিয়া স্বীকার করিলেন। মালাধর নিজ পত্রকে এবং বররগ নিজ কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ইহার শিষ্য করিয়া দিলেন। যামনে মানির শিষ্যগণের সকল বিদ্যা আয়ত্ত করিয়া রামানাজের শিক্ষা পূর্ণ হইল।