রামামুজ চরিত
দ্বিতীয় অধ্যায়- প্রথম পর্ব ( ১-৪)
বৈষ্ণবাচার্য যামুন মুনি
যাম, নাচার্য, পাণ্ডা রাজ্যের রাজধানী মদুরা নগরে, এক ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ- কলে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা ঈশ্বর মনি, পুত্রের জন্মের অল্প কাল পরেই, পরলোক গমন করেন। পিতামহ সিদ্ধযোগী নাথমনি তাঁহাকে লালনপালন করেন। অতি অল্প বয়সেই তাঁহার প্রতিভার বিকাশ হয়। তাঁহার জীবনের ঘটনাসমূহ উপন্যাসের ন্যায় মনোহর।
তখনকার দিনে পণ্ডিতদের ভারী সম্মান ছিল। বিশেষতঃ যাঁহারা কট তর্ক করিয়া অন্যের মত ভুল বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিতেন, সেই সব তার্কিক পণ্ডিত, রাজার মতো সম্মান পাইতেন। পাণ্ডা দেশের রাজার সভা- পণ্ডিত ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তার্কিক। তিনি সেই দেশের প্রায় সকল পণ্ডিতকে পরাজিত করিয়া, তাঁহাদের নিকট হইতে বার্ষিক কর আদায় করিতেন। লোকে তাঁহাকে নাম দিয়াছিল, "বিশ্বজ্জন-কোলাহল" ; কারণ, তিনি বিদ্বানগণের মধ্যে কোলাহল উপস্থিত করিয়াছিলেন। তাঁহার সম্মুখে কাহারও কথা কহিবার উপায় ছিল না। তাঁহার নিকট যদি কোনও মত কেহ প্রকাশ করিত, তিনি ন্যায়শাস্ত্রের যুক্তিবলে, তাহা ভ্রম বলিয়া প্রমাণ করিয়া দিতেন।
বালক যান ভাষ্যাচার্য" নামক একজন পণ্ডিতের নিকট শান্ত পাঠ করিত। বলা বাহুল্য, ভাষ্যাচার্য ও কোলাহল শর্মাকে কর দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। দরিদ্র ব্রাহ্মণ এক সময় দুই তিন বৎসর কর দিতে পারেন নাই। একদিন ভাষ্যাচার্য" বাড়ী ছিলেন না, এমন সময় কোলাহলের এক শিষ্য আসিয়া বার্ষিক করের জন্য খুব কটু, কথা বলিতে লাগিল। বালক যান, ভক্ত গর্র ফন্ড চেলাকে যথোচিত উত্তর দিয়া বলিল, “তোমার গরের যদি সাহস থাকে, আমার সঙ্গে তর্ক করুন। আমি কেমন গরুর শিষ্য, তাঁহাকে বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিব।” বালকের এইরূপে অসীম সাহসের কথা শানিয়া, কেহ ছেলেমানুষি, কেহ জ্যাঠামি মনে করিলেন। কিন্তু রাজা ধৃষ্টতার জন্য ছেলেটিকে শাস্তি দেওয়া কর্তব্য ভাবিয়া তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ভাষাচার্য ভয়ে অস্থির হইয়া উঠিলেন। কিন্তু বালক বিন্দুমাত্রও ভীত হইল না, বরং গরুকে নানা প্রকারে আশ্বাস দিতে লাগিল।
দেশের অনেকেই কোলাহল শর্মাকে ঘৃণা করিত। অহঙ্কারী, বিশেষতঃ পরকে অপমানকারী লোককে কে ভালবাসে? ছোট একটি ছেলে এত বড় পণ্ডিতের সহিত তর্ক করিতে আসিতেছে, এই সংবাদ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল এবং এই বিষয় নিয়া সর্বত্র বেশ একটি আন্দোলনের সৃষ্টি হইল। কোলাহলের শত্রুগণ বলিতে লাগিল, বামন যেমন বলিকে পরাস্ত করিয়া- ছিলেন, এই বালকও সেইরূপে দাম্ভিক পণ্ডিতের দর্প চূর্ণ করিবে। রানী এই মতাবলম্বী হইলেন। কিন্তু রাজা ছিলেন কোলাহলের গোঁড়া ভক্ত তিনি পণ্ডিতের পরাজয় সম্ভাবনা কল্পনাও করিতে পারিলেন না। রাজা ও রানীতে এই বিষয় নিয়া খুব তর্ক বাধিল। রানী বলিলেন, “যদি এই বালক তর্কে হারিয়া যায়, তবে, আমি সিংহাসন ছাড়িয়া আপনার দাসীর দাসী হইব।” রাজাও পণ করিলেন, “যদি কোলাহল শর্মা হারেন, তবে আমার রাজ্যের অর্ধেক এই বালককে দিব।”
শিশু যামনে রাজসভায় উপস্থিত হইলে, তাহার ক্ষুদ্র মূর্তি দেখিয়া, সকলে আশ্চার্যান্বিত হইয়া গেল। বালক গম্ভীর ভাবে সভায় বসিয়া, পণ্ডিতকে তর্কেেদ্ধ আহান করিল। পণ্ডিত, অতি অবজ্ঞার সহিত, যামনকে ব্যাকরণের সামান্য নিয়ম ও শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। বালক সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়া বলিল, “আপনি অবহেলা করিয়া আমাকে সামান্য সামান্য প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছেন। কিন্তু শরীর বড় হইলেই যদি জ্ঞান বেশি হইত, তবে একটি ষাঁড় আপনা হইতে বেশি জ্ঞানী হইত। এখন, আমি আপনার নিকট আমার কয়েকটি মত বলিতে চাই। আপনি তাহা খণ্ডন করিতে পারিলে, আমি পরাজয় স্বীকার করিব।”
কোলাহল শর্মা ভাবিলেন, “বালক এমন কি মত প্রকাশ করিবে, যাহা আমি খণ্ডন করিতে পারিব না! কত মহাপণ্ডিতের মত ভ্রান্ত বলিয়া প্রমাণ করিয়াছি। আমার পক্ষে এই শিশুর মত খণ্ডন করিতে যাওয়াই এক অপমান। এই শিশুর সঙ্গে আমার মতো মহাপণ্ডিতের তর্কযুদ্ধে দেখিতে কৌতূহলী হইয়া শত শত লোক আজ রাজসভায় উপস্থিত হইয়াছে। ইহাদের বর্ধিত কৌতূহলের সম্মুখে বালককে অবহেলা করিয়া প্রত্যাখ্যান করাও সম্ভব নহে।" এইরূপ সাত-পাঁচ ভাবিয়া, পণ্ডিত বাধ্য হইয়া, সামনের সাহিত তর্ক যদ্ধে সম্মত হইলেন।
তখন, বালক নিম্নলিখিত তিনটি অদ্ভুত মত তাঁহার নিকট প্রকাশ করিল। হয়, মতগুলি ভুল বলিয়া প্রমাণ করিতে হইবে, নয়, মানিয়া লইয়া পরাজয় স্বীকার করিতে হইবে।
১। আপনার মাতা বন্ধ্যা নহেন।
২। পান্ডা দেশের রাজা পরম ধার্মিক।
৩। পাণ্ডারাজ-মহিষী সতী।
কোলাহল শর্মা, তর্কশাস্ত্রের কাট কৌশল অবলম্বনে, সরল সত্যাশ্রয়ী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত খণ্ডন করিয়া, তাঁহাদিগকে অপমানিত করিতেন। তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার প্রথা ছিল না : পণ্ডিত- দের সভায় শাস্ত্রবিচার করিয়া পণ্ডিতগণকে নিজ পান্ডিত্যের প্রমাণ দিতে হইত। কালক্রমে এই প্রথা প্রথায় পরিণত হইল; তার্কিকগণ নানার প গণ রাখিয়া, পালোয়ানদের কুস্তির মত, তর্ক করিতে লাগিলেন। ইহাতে সত্য-নির্ণয় না হইয়া, কেবল তর্কশক্তির পরীক্ষা মাত্র হইত। তামাসা দেখিবার জন্য রাজা ও জনসাধারণ ইহা অননুমোদন করিতেন। তার্কিক কোলাহল, সারা জীবন এই ব্যবসা করিয়া, কত নির্দোষ ব্রাহ্মণকে মর্মপীড়া দিয়াছেন। আজ কিন্তু তিনি প্রমাদ গণিলেন। এই দ্বাদশবর্ষীয় বালকের মতগুলি শুনিয়া তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল। তিনি নিজে জীবিত থাকিতে তাঁহার মাতাকে কিরূপে বন্ধ্যা বলিয়া প্রমাণ করিবেন! রাজসভায় বসিয়া, রাজা ও রানীর সম্মুখে, রাজাকে পাপী ও রানীকে অসতী বলা বিষম বিপজ্জনক! আবার, বালকের মত মানিয়া লইলেও পরাজয়। পণ্ডিতের মুখে-চোখ লাল হইয়া উঠিল, গলা শুকাইয়া গেল, চোখের সম্মুখে পৃথিবী যেন ঘুরিতে লাগিল। তিনি কোনও উত্তর দিতে না পারিয়া চুপ করিয়া বসিয়া ঘামিতে লাগিলেন।
পণ্ডিতের এই অবস্থা লক্ষ্য করিয়া শত, মিত্র উভয় পক্ষ কোলাহল আরম্ভ করিলে, বালক দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিতে লাগিল, “আপনারা সকলে দেখিতেছেন, কোলাহল শর্মা আমার মত মানিয়া লইলেন, ইহার বিরুদ্ধে কিছুই বলিতে পারিলেন না। তিনি শাস্ত্র পড়েন নাই, কেবল কট বৃদ্ধির কৌশলে, প্রকৃত পণ্ডিতগণকে নিরুত্তর করিয়া, অপমানিত করিয়াছেন। আমার মত তিনটি বে শ্রমপূর্ণ, তাহা, আমি নিজেই, শাস্ত্রের দ্বারা প্রমাণ করিতেছি।
১ম—আপনারা জানেন, পণ্ডিত কোলাহল শর্মা তাঁহার মাতার একমাত্র সন্তান। শাস্ত্র বলেন, এক পাত্রের মাতা বন্ধ্যা। ২য় শাস্ত্রমতে, রাজা, প্রজার পাপ-পূণ্যের অংশ গ্রহণ করিয়া থাকেন। কলিযুগে অধিকাংশ প্রজাই পাপী। সুতরাং রাজা নিষ্পাপ হইতে পারেন
না।
৩য়—রাজার দেহে আটজন 'লোকপাল' দেবতা বাস করেন। এই কথা কে না জানে ? সতরাং কোনও রাজমহিষীকেই, বিচার-দৃষ্টিতে, সতী বলা যায় না।
বালক যান, তাহার মত সমর্থনের জন্য, নানা শাস্ত্র হইতে শ্লোক
জাবৃত্তি করিয়া সকলকে আশ্চর্যান্বিত করিল। পণ্ডিত, পরাজয় স্বীকার
করিয়া, সভা হইতে উঠিয়া গেলেন। রাজা নিজ প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য,
যামনেকে অর্ধ রাজ্যের অধীশ্বর বলিয়া স্বীকার করিলেন।
যামনে বাদশবর্ষীয় বালক হইলেও রাজ্যলাভ করিয়া অত দক্ষতার সহিত রাজ্য পরিচালন করিতে লাগিলেন। কিন্তু যৌবনেই সংসারের অসারতা বুঝিতে পারিয়া, তিনি সংসার ত্যাগ করেন এবং সাধারণ বৈরাগীদের ন্যায় ভিক্ষান্ন জীবন ধারণ ও শ্রীরমানাথের সেবায় আত্মসমর্পণ করেন। তাঁহার বৈরাগ্য, পাণ্ডিত্য প্রভৃতি সদগণে মুখে বৈষ্ণবসমাজ তাঁহাকে নেতৃত্বে বরণ করিলেন। তাঁহার বহ, শিষ্য হইল; তাঁহাদের মধ্যে কাঞ্চীপূর্ণ, মহাপূৰ্ণ, শৈলপূর্ণ, মালাধর, তিরানা এবং বররা প্রভৃতি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
(২)
রামানুজ ও বৈষ্ণবসমাজ
বৈষ্ণবগণ রামানাজের দিকে তাঁকা দৃষ্টি রাখিতেন। রামানুজে শৈল- পূর্ণের ভাগিনেয়, বাল্যকাল হইতে কাশ্মীপূর্ণের অনুগত এবং সর্বতোভাবে বৈষ্ণবভাবাপন্ন ; আবার, অসামান্য প্রতিভা সম্পন্ন। এমন লোককে কোন সম্প্রদায় না আকাঙ্ক্ষা করে? কিন্তু তিনি যাদবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করাতে, বৈষ্ণবগণ হতাশ হইলেন।
একবার, যামন মনি, শ্রীবরদরাজ দর্শনে, কাশ্মীরে গিয়াছিলেন। তথায় যাদবের সঙ্গে রামানজেকে দেখিয়া, তিনি বুঝিয়াছিলেন, ইনি বৈষ্ণবসমাজে নেতৃত্ব করিবার জন্য জন্মিয়াছেন। প্রচণ্ড তার্কিক যাদবের নিকট হইতে রামানন্দজকে আকর্ষণ করিয়া আনিবার চেষ্টা করিলে, শৈবদের সঙ্গে বিবাদ হইতে পারে। তাই ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া অপেক্ষা করাই নি ভাল মনে করিলেন।
মাতুলের গরু, সিদ্ধ-মহাপুরুষ সামনে মানির বিষয় রামানুজে ভাল ৰূপেই জানিতেন। কিন্তু শাস্ত্রপাঠের আগ্রহ হেতু, সময় করিয়া, তাঁহাকে দর্শন করিতে যাইতে পারেন নাই। এখন, যাদবের সহিত মতান্তর হওয়াতে, তিনি তাঁহার সঙ্গ ত্যাগ করিয়াছেন এবং কাশ্মীপূর্ণের উপদেশ অনুসারে সাধন- ভজন করিতেছেন, এই সংবাদ পাইয়া বৈষ্ণবগণ উৎপন্ন হইলেন।
বৃদ্ধ যান নি ভাবিয়াছিলেন, একদিন না একদিন রামানন্দজ তাঁহার নিকটে আসিবেই। কিন্তু সহসা তাঁহার শরীর অত্যন্ত অসস্থ হইয়া পড়িল। বৈষ্ণব সম্প্রদায় রক্ষা সম্বন্ধে কতকগুলি প্রয়োজনীয় বিষয় বলিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া, তিনি, রামানজেকে কাশ্মীরে হইতে শ্রীরামে লইয়া আসিতে, শিষ্য মহাপর্ণে'কে পাঠাইলেন। শ্রীবরদরাজের মন্দিরে, তাঁহার সহিত রামানন্দজের সাক্ষাৎ হইল। মনি অসস্থ এবং তাঁহাকে দেখিতে চাহিয়াছেন, এই সংবাদ পাওয়া মাত্র রামান্দজ মহাপর্ণের সঙ্গে শ্রীরলাম যাত্রা করিলেন বাড়িতে এই সংবাদ দিতে গেলে যেটাক, সময় লাগে, তাহাও নষ্ট করিতে তাঁহার প্রবৃত্তি হইল না। এত ব্যাকুল ভাবে ছটিয়াও শ্রীরঙ্গমে পৌঁছিয়া তাঁহারা দেখিলেন, মনি শরীর ত্যাগ করিয়াছেন; সৎকারের জন্য তাঁহার দেহ কাবেরী তাঁরে আনা হইয়াছে। এই করুণ দৃশ্য দেখিয়া তাঁহারা শোকে অভিভূত হইলেন।
রামানন্দজ দঃখে, ক্ষোতে, অভিমানে অধীর হইয়া শ্রীরামের অধিষ্ঠাতা শ্রীরঙ্গনাথকে দর্শন না করিয়াই, তৎক্ষণাৎ কাঞ্চী যাত্রা করিলেন। সেইদিন। শ্রীরামের প্রায় সকল বৈষ্ণবই কাবেরী তীরে সমবেত হইয়াছিলেন। রামা- নজের আকৃতি, প্রকৃতি ও কথাবার্তা, অল্প সময় লক্ষ্য করিয়াই সকলে বুঝিতে পারিলেন, এই ব্যক্তিই যামু নাচার্যের আসনে বসিবার উপযুক্ত ।
(৩)
কাঞ্চিপূর্ণ সঙ্গে
পান্ডিত্যলাভের নেশায় হীনবদ্ধি যাদবের সেবা করিয়া বৃথা আয়, ক্ষয় হইয়াছে, যান মনির ন্যায় মহাপুরুষের সেবা করিলে জ্ঞানভান্ত লাভ হইত, এইরূপে চিন্তা করিয়া অনুশোচনানা রামানুজের হৃদয় দগ্ধ হইতে লাগিল। শান্তিলাভের জন্য ব্যাকুল হইয়া তিনি ভগবানের চিন্তায় মগ্ন হইলেন। তিনি কাঞ্চীপূর্ণকে গরু, বলিয়া মনে করিতেন। কিন্তু কাণ্ডীপূর্ণ, শ ছিলেন বলিয়া, রামানুজেকে শিযা রূপে গ্রহণ করিতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না। বৈষ্ণবগণ বলেন, ভক্তের উচ্ছিষ্ট খাইলে ভক্তি হয়। তাই রামানুজে কাঞ্চীপ,র্ণের ভক্তাবশিষ্ট খাইয়া ভক্তিলাভ করিবার জন্য, একদিন তাঁহাকে নিজ গৃহে নিমাণ করিলেন।
পত্নী জমারা, রামানাজের আদেশে মহাপরুষের জন্য নানা প্রকার ব্যঞ্জনাদি রন্ধন করিলেন। রামানাজ কাঞ্চীপূর্ণকে লইয়া আসিবার জন্য গৃহ হইতে বাহির হইলেন। কাঞ্চীপূর্ণ রামানাজের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া- ছিলেন রামানুজে বাড়ি হইতে চলিয়া যাওয়া মাইে তিনি আসিয়া খুব ব্যস্ত ভাবে জমাম্বাকে বলিলেন, “মা, তুমি যাহা রাঁধিয়াছ, আমাকে তাহাই দাও, আমাকে এখনই মন্দিরে গিয়া ঠাকরের সেবা করিতে হইবে। বিলম্ব হইলে আমার খাওয়া হইবে না।” জমাম্বা তাঁহার ব্যস্ততা দেখিয়া, বাধ্য হইয়া, তাড়াতাড়ি পরিবেশন করিলেন। কাজীপর্ণে, যত শীঘ্র সম্ভব থাইয়া, এ’টোপাত ফেলিয়া এবং স্থান পরিষ্কার করিয়া, চলিয়া গেলেন। শূদ্রকে খাদ্যের অগ্র- ভাগ দেওয়া হইয়াছে, তাই পাকশালার সমস্ত অন্ন-ব্যঞ্জন ফেলিয়া দিতে হইল। রান্নাঘর ধুইয়া, স্নান করিয়া, জমাম্বা আবার স্বামীর জন্য রাঁধিতে বসিলেন।
মন্দিরে বা অন্য কোনও স্থানে কাঞ্চীপূর্ণকে দেখিতে না পাইয়া, রামানাজ গ্রহে ফিরিলেন। কাশ্মীপূর্ণ যে তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিয়াই এরূপ ব্যস্ততা দেখাইয়া ভাল করিয়া আহার করেন নাই, তাহা বুঝিতে পারিয়া রামানুজে বেই দুঃখিত হইলেন। জমা বা এত বড় মহাদেকে রে জ্ঞান করিতেছেন দেখিয়া, তিনি আরও মর্মাহত হইলেন। কিন্তু দোষ কাহারও ছিল না। সমাজের নিয়ম তিল মাত্র ভঙ্গ করা তখন ঐ অঞ্চলে মহা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইত।
ঐ অঞ্চলে তখন শূদ্রের ছায়া মাড়াইলেই মহাপাপ হইত। এই অবস্থায় শাস্ত্রের উচ্ছিষ্ট খাওয়া অতি সাহসের কাজ। ইহাতে বুঝা যায়, ভগবান্ লাভের জন্য রামানাজ কত ব্যাকুল হইয়াছিলেন। দীক্ষা ব্যতীত সাধনা পূর্ণ হয় না। তাই, যাম,নাচার্যের শিষ্য, ব্রাহ্মণ মহাশূর্ণের নিকট হইতে দীক্ষা গ্রহণ করিতে, কাঞ্চীপূর্ণ তাঁহাকে উপদেশ দিলেন। অবিলম্বে, দীক্ষিত হইবার জন্য, তিনি শ্রীরঙ্গম যাত্রা করিলেন।
(৪)
দীক্ষা
যাম,নাচার্যের দেহত্যাগের পর, তির বরাঙ্গ শ্রীরঙ্গনাথের মন্দিরের অধ্যক্ষ হইলেন। আচার্যে'র শিষ্যগণের মধ্যে অনেক সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের সঙ্গে শারবিচার করিয়া বৈষ্ণব মত রক্ষা করিবার মতো পাণ্ডিত্য ও তেজস্বিতা কাহারও ছিল না। আচার্যদেব রামানজেকে বৈষ্ণব সমাজের নেতা করিতে চাহিয়াছিলেন এবং বৈষ্ণবগণও বুঝিয়াছিলেন, যামু,নাচার্যের আসনে বসিবার উপযুক্ত ব্যক্তি একমাত্র রামান্দজ। তাই, তাঁহারা সকলে পরামর্শ করিয়া, রামানজেকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত ও শিক্ষিত করিবার জন্য, পণ্ডিত মহাপর্ণেকে কাশ্মী যাইতে অনুরোধ করিলেন। বেশিদিন থাকিবার প্রয়োজন হইতে পারে ভাবিয়া, মহাপূর্ণ দীকে সঙ্গে লইয়া, কাঞ্চী যাত্রা করিলেন। অপর দিক হইতে, দীক্ষা লইবার জন্য, রামানাজেও শ্রীরঙ্গমের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। মধ্যপথে উভয়ে মিলিত হইলেন। উভয়ে উভয়ের উদ্দেশ্য জানিয়া পরম আনন্দ লাভ করিলেন। রামানাজের মনে যখন যে সংকল্প উঠিত, তাহা কার্যে পরিণত করিতে তাঁহার বিলম্ব সহিত না। তিনি, সেই স্থানেই দীক্ষা গ্রহণ করিয়া, বৈষ্ণবসঙ্ঘের অন্তর্ভুক্ত হইলেন।
রামানুজে গরুকে সঙ্গে লইয়া আসিয়া নিজ গহে স্থান দিলেন। তাঁহার পত্নীও মহাপর্ণের নিকট হইতে দীক্ষা গ্রহণ করিলেন। বৈষ্ণবধর্মে'র অনেক গ্রন্থ তামিল ভাষায় রচিত। রামাজে গুরুর নিকট সেই সব পুতেক পাঠ করিতে লাগিলেন।