।। রামানুজ চরিত ।। Ramanuj Charit ।। #দ্বিতীয় অধ্যায় ##দ্বিতীয় পর্ব


রামামুজ চরিত

তৃতীয় অধ্যায়- দ্বিতীয় পর্ব ( ৫-৭)

(৫)

জমাম্বা

ভগবানের ধ্যান-চিন্তায় এবং মহাপর্ণে ও কাশ্মীপূর্ণের সঙ্গে হরি কথায়, রামানুজের দিন আনন্দে কাটিতে লাগিল। কিন্তু সংসারের কাজে তাঁহার অমনোযোগ দেখিয়া, জমাম্বা বিরক্ত হইতে লাগিলেন। ক্রমে ব্যাপার গরতের হইয়া উঠিল। রামানজে অতিথি ও দরিদ্রদিগকে খাওয়াইতে ভালবাসিতেন। জমাম্বা অভিমান করিয়া এই কাজে অবহেলা ও বিরক্তি দেখাইতে লাগিলেন। দিন দিন স্বামী-স্থীর মতান্তর বাড়িয়া উঠিতে লাগিল।

একদিন সকালবেলা রামানুজে দেখিলেন, একটি লোক উপবাসে বড় কষ্ট পাইতেছে। ্যাঁকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, লোকটিকে খাইতে দিবার মতো কোনও কিছু ঘরে নাই। কিন্তু তাঁহার মনে সন্দেহ হইল। জমাম্বা অন্য কাজে সরিয়া গেলে, রামাজে সন্ধান করিয়া দেখিলেন, রান্না ঘরে প্রচুর বাসি ভাত রহিয়াছে। ইহাতে রামাজে বড়ই ব্যথিত হইলেন।

একদিন জমাম্বা ও গর্, মহাপর্ণের স্ত্রী, এক সঙ্গে এক কয়া হইতে

জল তুলিতেছিলেন। গুরুপত্নীর কলসী হইতে দুই এক ফোঁটা জল জমাবার কলসীতে পড়িয়া গেল। ইহাতে জমাম্বা বিষম রুদ্ধ হইয়া, তাঁহাকে নানা কটা কথা বলিতে লাগিলেন। মহাপূর্ণ পূর্বে হইতে জমাবার মতিগতি লক্ষ্য করিতেছিলেন। এই

ব্যাপার এইখানেই শেষ হইবে না এবং গরু-শিষ্যের কলহ বড়ই লজ্জার বিষয়, এই ভাবিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ সন্ত্রীক শ্রীরঙ্গম যাত্রা করিলেন। রামাঞ্জে বাড়িতে ছিলেন না। বাড়ি ফিরিয়া তিনি এই ঘটনা জানিতে পারিয়া বুঝিলেন, হাঁকে নিয়া সংসার-ধর্ম" পালন করা তাঁহার পক্ষে কঠিন। তাঁহার নিজের মনের যে অবস্থা, তাহাতে প্যাঁকে নিয়া আমোদ করিয়া তাঁহাকে খুশি করা একান্ত অসম্ভব। ভগবানের কথা, ভগবানের চিন্তা ছাড়া অন্য কোনও বিষয় তাঁহার ভাল লাগে না; এমন কি যাহারা ভগবানের চিন্তা করে না তাহা- দের সঙ্গে থাকাও কষ্টকর মনে হয়। স্ত্রী যদি স্বামীর ধর্মে'র সহায় না হন, তবে স্বামীর পক্ষে ধর্মপথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় না। আর যদি স্ত্রী বামীর বিরোধী হন, তবে উভয়ের এক সঙ্গে বাস উভয়ের পক্ষেই অমলাল- জনক। রামানন্জে স্ত্রীকে তাঁহার সাধন-পথে আনিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিলেন ; কিন্তু জমাবার মন কিছুতেই ফিরিল না। তখন আর কোন উপায় নাই দেখিয়া, তিনি প্যাঁকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাইয়া দিলেন।

বুদ্ধদেব, শ্রীগৌরাণা প্রভৃতি মহাপুরুষগণ হাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ ত্যাগ করিলেও, তাঁহাদের পত্নীগণ স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করিয়া, অতি মহৎ জীবন যাপন করেন। তাঁহারা, স্বামীর ভক্তসম্প্রদায়ে, এক বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া- ছিলেন। কিন্তু দঃখের বিষয়, জমাদা সম্বন্ধে আমরা আর কিছুই জানি না। 


(৬)

সন্ন্যাস


রামানন্দজের সংসারের একমাত্র বন্ধন খসিয়া পড়িল। হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মচর্য', গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই চারিটি আশ্রম বা সাধন-পথ আছে। প্রত্যেক হিন্দুকে ইহার মধ্যে কোনও একটি আশ্রমের অন্তর্ভুক্ত থাকিতে হয়। স্ত্রী ছাড়া গার্হস্থ্য আশ্রমে থাকা যায় না। সেই জন্য রামানন্জে এখন সন্ন্যাস আশ্রমে প্রবেশ করিতে কৃত-সংকল্প হইলেন। তিনি নিজ গ্রাম পেরেমবন্দরে যাইয়া, সমদেয় বিষয়-সম্পত্তি আত্মীয়গণকে দান করিলেন এবং আদি-কেশবের মন্দিরে ঠাকরের সম্মুখে, কৌপীন, গৈরিক বর, দত্ত ও কমন্ডল, ধারণ করিয়া সন্ন্যাসী হইলেন।

রামানুজে, মহৎ চরিত্র ও প্রতিভা হেতু, কাঞ্চীপ রে খুব প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করায় নগরের সর্বত্র এই বিষয়ে আলোচনা হইতে লাগিল। তিনি শ্রীবরদরাজের সেবা, সাধন-ভজন ও শাস্ত্র ব্যাখ্যা করিয়া নগরে একটি প্রবল ধর্ম আন্দোলন উত্থাপন করিলেন। নগরের সকল শ্রেণীর লোক তাঁহার নিকট আসিতে লাগিল। তাঁহার ভাগিনেয় পণ্ডিত দাশরথি এবং করে আহারের বিখ্যাত দাতা ও প্রতিধর পণ্ডিত করেশ প্রভৃতি অনেক প্রসিদ্ধ লোক তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন। তাঁহার অসাধারণ ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হইয়া বৈষ্ণব সমাজ পরম উৎসাহে তাঁহাকে নেতৃপদে বরণ করিলেন। 

(৭)

যাদবের পরিণাম

দেশের লোক রামান,জকে নিয়া মাতিয়া উঠিলে, যাদবের অবস্থা শোচনীয় হইল। যে যাদব কান্তী নগরে রাজার মতো সম্মানিত ছিলেন, আজ রামানাজের ভেজে তিনি লান দিবা-প্রদীপের ন্যায় নিস্তেজ। ঈর্ষা, পূর্ব পাশের অন- শোচনা, পরকালের ভয় ইত্যাদি নানা মর্মপীড়ায় তিনি দগ্ধ হইতে লাগিলেন। যাদবের বৃদ্ধা মাতা তখনও জীবিত ছিলেন। বরদরাজের মন্দিরে

রামানুজের জ্যোতিময় মূর্তি দেখিয়া বৃদ্ধার বোধ হইল, যেন সাক্ষাৎ ভগবান সম্মুখে উপস্থিত। পত্রের পূর্ব চরিত্র ও বর্তমান মানসিক অশান্তি মাতার অজ্ঞাত ছিল না। তিনি ঘরে ফিরিয়াই নিজ অনুভবের কথা পত্রকে বলিতে লাগিলেন এবং “কথার ধর্ম” ও ভণ্ডামি ছাড়িয়া এই মহাপুরুষের আশ্রয় নিতে তাঁহাকে উপদেশ দিলেন।

যাদব দুশ্চিন্তায় পাগলের মতো হইয়া পড়িয়াছেন। প্রথমতঃ তিনি ভাবিলেন, তীর্থযাত্রা উপলক্ষ করিয়া কাজী হইতে চলিয়া যাইবেন। কিন্তু এত কাল এক স্থানে শারীরিক আরামে থাকায়, এখন বৃদ্ধ বয়সে দেশে দেশে পরিব্রাজক হইয়া বেড়াইবার, কিংবা কষ্ট করিয়া দূর তীর্থে বাস করিবার সাহস তাঁহার আর নাই। আবার কাঞ্চীতে, অজ্ঞাত অখ্যাত হইয়া এক কোণে পড়িয়া থাকিয়া, লোককে মুখ দেখানোও অসম্ভব।

স্নেহময়ী মাতা প্রতিদিন, বার বার, বলিতে লাগিলেন, এই মহাপরুষের আশ্রয় নিলেই যাদব শান্তি পাইবেন। কিন্তু তাঁহার ন্যায় জ্ঞানবৃদ্ধ, বয়োবৃদ্ধ লোকের পক্ষে, নিজের একটি বেক শিষ্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ একান্তই অসম্ভব। যাদব প্রথম জীবনে, মুক্তি লাভের জন্য সর্বত্যাগের সংকল্প করিয়াছিলেন।

জ্ঞান লাভের জন্য শান্ত পড়িতে যাইয়া, তুচ্ছ মান যশের মোহে, আজ তাঁহার এই দুর্দশা। ভগবান লাভ করিলে, নিজ অন্তরে ব্রহ্মান, ভব হইলে, মানুষে অনন্ত আনন্দের অধিকারী হয় এবং দেবতারও পূজো হয়,— এই সব কথা বৎসরের পর বৎসর, শত সহস্র বার আলোচনা করিলেও, কি এক দৈবশক্তিবশে মুগ্ধ হইয়া, তিনি সেই অবস্থা লাভের চেষ্টা করেন নাই। আজ তিনি নিঃস্ব, নিরুপায়। এই বয়সে জ্ঞান লাভের জন্য কঠোর সাধন ভজন করিবার সাহস ও তাঁহার আর নাই। অনুশোচনার বেদনায় তাঁহার হৃদয় ভরিয়া উঠিল, জীবন দুর্বিষহ বোধ হইতে লাগিল।

এই সময়ে ঘটনাক্রমে একদিন বরদরাজের মন্দিরে রামানাজের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। রামানাজে পরম ভক্তি সহকারে পূর্বের ন্যায় যাদবকে গর্বং সম্মান করিয়া বসাইলেন। উভয়ের মধ্যে কিছ, শাস্ত্র আলোচনা হইল। শঙ্ক পণ্ডিত যাদব, রামানাজের বিনয়ে, মহত্ত্বে ও তেজে অভিভূত হইয়া পড়িলেন। কি এক দৈববলে, যেন, তাহার মন হইতে রামানুজের প্রতি অপ্রীতি ও অবজ্ঞার ভাব দূর হইয়া গেল এবং বর্তমান মনোবেদনার স্থলে শিষ্যের প্রতি পূর্ব স্নেহ প্রবল হইয়া সকল অশান্তি দূর করিল। ভগবানের কৃপায় অসম্ভবও সম্ভব হইয়া যায়।

এখন মধ্যে মধ্যে রামানুজের নিকট যাইয়া, তিনি ভগবৎ-তত্ত্ব আলোচনা করিতে লাগিলেন। পণ্ডিত ক্রমে ক্রমে বুঝিতে পারিলেন, ভগবান্ লাভ করিলে মানুষের জীবনে যে সব পরিবর্তন আসিয়া উপস্থিত হয়, চরিত্রে যেরূপ মাধমে বিকাশের কথা শাস্ত্রের লিখিত আছে, রামানুজের মধ্যে তাহার পূর্ণ প্রকাশ হইয়াছে। পরন্তু, অন্যকে ধর্ম অনুভব করাইবার যে ঐশ্বরিক শক্তি কেবল অবতার পেেষই বিশেষ ভাবে দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাও রামানন্দজের মধ্যে রহিয়াছে।

যাদব এতকাল কেবল, “কাঠে আছে আগুনে, কাঠে আছে আগুন” বলিয়া অন্যকে উপদেশ দিয়াছেন; নিজে সেই আগুন জালিয়া, রাঁধিয়া খাইয়া যে তুষ্টি পাষ্টি হয়, তাহার চেষ্টা করেন নাই। এখন, রামানাজের মধ্যে সেই ব্রহ্মানন্দের স্ফূরণ দেখিতে পাইয়া তাঁহার পূর্বসংস্কার ফিরিয়া আসিল। এই ক্ষণস্থায়ী তুচ্ছ মান-অপমানের হিসাব করিয়া, এমন মহাপেেষর সহায়তা হইতে নিজেকে বঞ্চিত করা যে কত মূঢ়তা, শাস্ত্রজ্ঞ যাদব তাহা এখন বেশ বুঝিতে পারিলেন। জন্ম-জন্মার্জিত শুভ সংস্কার জয়ী হইল, সকল অভি- মান ত্যাগ করিয়া যাদব রামানাজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন।

এই সংবাদ অচিরে প্রচারিত হইয়া, দেশে এক বিপলে ধর্মান্দোলন উপস্থিত করিল। রামানুজের মধ্যে যে ভগবৎ-শক্তির বিশেষ প্রকাশ হইয়াছে, লোকে তাহা বুঝিতে পারিল। তাঁহার যশোগানে দক্ষিণাপথ মুখরিত হইয়া উঠিল।

RJKB

RJKB stands for Raja Jnana Karma Bhakti. In this blogger site, you will get many more life building thoughts which will increase your Spiritual Power. So join this blog & start your Spiritual Journey. আর জে কে বি মানে রাজ জ্ঞান কর্ম ভক্তি। এই ব্লগার সাইটে, আপনি আরও অনেক জীবন গঠনের চিন্তা পাবেন যা আপনার আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করবে। সুতরাং এই ব্লগে যোগ দিন এবং আপনার আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করুন।

Post a Comment

Previous Post Next Post