।। রামানুজ চরিত ।। Ramanuj Charit ।। #পঞ্চম অধ্যায়



(১)

 আচার্যের উদারতা

সাধারণতঃ লোকের ধারণা, বৈষ্ণব ধর্ম গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু লক্ষ্য করিলে দেখা যায়, জগতে প্রচলিত কোনও ধর্মই এই দোষ হইতে সম্পূর্ণ মক্ত নহে। নিজের সম্প্রদায়ের গৌরব ও অন্য সম্প্রদায়ের হীনতা সকল ধর্মা- বলম্বীরা সমভাবে ঘোষণা করিয়া থাকেন।

শষ, ধর্ম সম্বন্ধেই যে মানব-মনের এই দুর্বলতা প্রকাশ পায়, তাহা নহে ; স্বজাতির ভাষা, আচার ব্যবহার, খাদ্য বস্তু, এমন-কি দেহের বর্ণ ও গঠন এবং পোশাক-পরিচ্ছদে, মান্নুষ সৌন্দর্য মাধ্যর্য দেখিতে পায়; কিন্তু অন্য জাতির ঐগুলির নিন্দাই করিয়া থাকে। মানব-বুদ্ধির অপূর্ণতাই তাহার সর্ববিধ গোঁড়ামির জন্য দায়ী; কোনও ধর্ম বিশেষকে এই জন্য দোষী মনে করিলে অত্যন্ত ভুল করা হয়।

ধর্ম ব্যতীত এই ভেদবদ্ধি দূর করিবার উত্তম উপায় আর নাই। সকল ধর্মের, মূল তত্ত্ব লক্ষ্য করিলে, ইহা স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায়, মনের যে মলিনতা হইতে ভেদব,দ্ধির উৎপত্তি, সেই মলিনতা দূর করাই ধর্ম সমমূহের একমাত্র উদ্দেশ্য। দেখা যায়, যাঁহারা যথারীতি সাধন ভজন করেন, সকল ধর্মে'র সেই সব সাধক, ক্রমে ক্রমে ভেদ-দৃষ্টি রহিত হইয়া উদারতার চরম সীমায় উপস্থিত হন।

সকল ধর্মের প্রবর্তকগণই এক বাক্যে বলিয়াছেন, অনন্য মনে তাঁহাদের প্রদর্শিত পথে চলিলে সকল দূর্বলতার হাত হইতে মানষে নিষ্কৃতি পাইবে । কিন্তু মানুষ স্বধর্মে অনন্যমন না হইয়া, অন্য পথের দোষ ঘোষণা ও নিজ মতের গৌরব ব্যাখ্যায় শক্তি ক্ষয় করে, পথে চলা আর হইয়া উঠে না। তাহা হইতেই গোঁড়ামি ও ধর্ম-বিদ্বেষের উৎপত্তি।

বাল্যকাল হইতেই আচার্য রামানাজের উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়।

শৈশবে তিনি শস্ত্র কাঞ্চীপ র্ণকে ভক্তি করিতেন, সেবা করিতেন। যৌবনে আভেনামতির জন্য, সেই মহাপুরুষের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করিতে উদ্যত হইয়া- ছিলেন। আচার্য রূপে ধর্ম প্রচার কালে, যে কোনও জাতীয় ব্যক্তি বৈষ্ণব সদাচার গ্রহণ করিলে, তাহাকে নিজ সম্প্রদায়ে গ্রহণ করিতেন।

শ্রীরলামে জনৈক শস্ত্র বৈষ্ণবের মৃত্যু হইলে, আচার্যের গল্প মহাপূর্ণ ব্রাহ্মণদের নিয়ম অনুসারে তাহার দেহের সৎকার করেন। ইহার প্রতিবাদ করিয়া গোঁড়ারা খুব একটা আন্দোলন উপস্থিত করে। পণ্ডিত মহাপূর্ণ নিজ কার্য' সমর্থন করিয়া অনেক শাস্য-প্রমাণ দেখাইলেও গোঁড়ারা নিরস্ত হইল না। আচার্যদেব গুরুর পক্ষ সমর্থন করিয়া বিবাদ ভঞ্জন করেন। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারকদের উদারতায় ব্যাধ প্রভৃতি অনেক অনুন্নত জাতি

বৈষ্ণব-দীক্ষা গ্রহণ করিয়া সদাচার-সম্পন্ন হইয়াছিল।

(২)

কৃমীকন্ঠ

ধর্মের মূল, সাধনা। সাধনাহীন সম্প্রদায় রুমে নষ্ট হইয়া যায়। শৈবগণ সাধনা ছাড়িয়া দলাদল ও সামাজিকতা নিয়া যাস্ত থাকিতেন। বৈষ্ণবগণ সাধনাবলে যতই সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে লাগিলেন, শৈবগণ ততই খালিয়া আরও দুর্বল হইতে লাগিলেন।

তখন কাঞ্চীপুরে ছিল চোল রাজ্যের রাজধানী : শ্রীরামও চোল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বৃদ্ধ চোল-রাজের মৃত্যু হইলে, তাঁহার মূর্খ, নিষ্ঠুর ও পাপাওনা পরে কমিকণ্ঠ সিংহাসনে বসিল। সুযোগ পাইয়া দৃষ্টে শৈবগল চাটা বাক্যে তাহাকে বশ করিল এবং বৈষ্ণবদের বিরুদ্ধে ক্ষেপাইয়া তুলিল। কৃমিকণ্ঠ রাজ্যে ঘোষণা করিল যে, তাহার রাজ্যে সকলকেই শৈব হইতে হইবে ; শব্দে তাহা-ই নহে, প্রত্যেককে লিখিয়া দিতে হইবে, 'শিবাৎ পরতরং ন হি' অর্থাৎ শিব হইতে শ্রেষ্ঠ কেহ নাই। এইরূপে লিখিয়া দিতে অসম্মত হইয়া, অনেক বৈষ্ণব কঠোর শাস্তি ভোগ করিতে লাগিলেন। দৃষ্টে রাজা ভাবিল, “রামান জেটাই যত নষ্টের গোড়া, উহাকে দিয়া লিখাইয়া লইলেই সব বৈষ্ণব জব্দ হইবে ; আর, সে যদি লিখিতে সম্মত না হয়, তাহাকে মারিয়া ফেলিলেই সব বৈষ্ণব ভয়ে শৈব ধর্ম গ্রহণ করিবে।" রাজা রামানাজকে ধরিয়া আনিবার জন্য শ্রীরঙ্গমে সৈন্য পাঠাইল। এই সংবাদ পাইয়া, আচার্য দেবকে রক্ষা করিবার জন্য শিষ্যগণ অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া পড়িলেন। তাঁহাদের প্রবল আগ্রহে বাধ্য হইয়া আচার্যদেব, গৃহস্থের বেশ ধারণ করিয়া, শ্রীরঙ্গম হইতে পশ্চিমদিকে পলায়ন করিলেন। তাঁহাকে পথে রক্ষা করিবার জন্য, কয়েকজন শিষ্যও সঙ্গে গেলেন।

রাজার সৈন্যগণ শ্রীরঙ্গমে আসিয়া রামানাজের মঠে উপস্থিত হইল । করেশ আচার্যের বেশ ধারণ করিয়া, ধৃত হইবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। সৈন্য- গণ রামানাজ মনে করিয়া করেশকে ধরিয়া লইয়া গেল। রাজসভায় উপস্থিত হইলে, পণ্ডিতগণও রামানজে মনে করিয়া করেশকে শাস্ত্রীয় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। মহাপণ্ডিত শ্রুতিধর করেশের সঙ্গে বিচার করিবার ক্ষমতা কাহারও ছিল না; শৈব পণ্ডিতগণ কিছুক্ষণ তর্ক করিয়া নিরস্ত হইলেন। তখন রাজা তাঁহাকে বলিলেন, “হে বৈষ্ণব, যদি প্রাণ বাঁচাইতে চাও, তবে লিখিয়া দাও, 'শিবাৎ পরতরং ন হি ।” নির্ভীক করেশ হাস্য করিয়া উত্তর দিলেন, "দ্রোণমস্তি ততঃ পরম” – অর্থাৎ দ্রোণ তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ। আমাদের দেশের সের ও পরির * ন্যায় ঐ দেশে শিব ও দ্রোণ নামে দই,টি মাপ ছিল ; করেশ উপহাসের ছলে, শিব অর্থে দেবতা না বুঝিয়া যেন মাপ বুঝিতেছেন এইরূপে ভান করিয়া, শিব হইতে দ্রোণ যে বেশি এই কথাটা তাহা- দিগকে স্মরণ করাইয়া দিলেন।

রাজা এই উপহাস শুনিয়া বিষম ক্রুদ্ধ হইলেন। তাঁহার আদেশে, ঘাতক- গণ, কেেরশকে মশানে লইয়া গিয়া, তাঁহার চক্ষু, দুইটি উৎপাটিত করিয়া ফেলিল। ভগবানকে স্মরণ করিতে করিতে রেশ স্থির হইয়া রহিলেন। শরীরের উপর তাঁহার 'আমি' বৃদ্ধি ছিল না ; তিনি সকলের ভিতর তাঁহার ইষ্ট দেবতা বিষ্ণুকে দেখিতে পাইতেন ; তাই, ঘাতকদিগকে নারায়ণ জ্ঞানে প্রণাম করিলেন। ঘাতকগণ ব্ৰহ্মতেজে দীপ্তিমান করেশের ব্যবহারে ভয় পাইল এবং লোক সঙ্গে দিয়া চক্ষুহীন করেশকে শ্রীরঙ্গমে পাঠাইয়া দিল। 


(৩)

নির্বাসিত

আচার্য দেব ছদ্মবেশে পশ্চিমদিকে চলিতে লাগিলেন। দাশরথি, গোবিন্দ ও ধন দাস তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। তাঁহারা আহারনিদ্রা ত্যাগ করিয়া, ঢোল রাজ্যের বাহিরে যাইবার জন্য, অবিরত চলিতে চলিতে অবসন্ন হইয়া পড়িলেন। ষষ্ঠ দিবস রাত্রে ভয়ানক বৃষ্টি হইতে লাগিল । তাঁহারা তখন নীলগিরির নিকট এক ব্যাধের বাড়িতে আশ্রয় লইলেন।

তখন দক্ষিণাপথে আচার্যের কথা জানিত না এমন লোক বিরল ছিল। ঐ গ্রামের ব্যাধগণ জনৈক ভক্ত কর্তৃক বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিল। তাহারা যখন আচার্যের পরিচয় পাইল, তখন তাহাদের আনন্দের সীমা রহিল না। ফলম,ল, মধ, প্রভৃতি যাহা কিছ, বনে পাওয়া যায়, তাহা দিয়া তাহারা সশিষ্য আচার্য দেবের সেবা করিতে লাগিল। তিনি কয়েক দিন তাহাদের সঙ্গে থাকিয়া বিশ্রাম করিলেন। ব্যাধগণও তাঁহার সঙ্গ পাইয়া ধন্য হইল।

আচার্যদেব অনেক দিন অন্ন গ্রহণ করেন নাই। তাই ব্যাধগণ নিকটবর্তী এক গ্রামে তাহাদের পরিচিত রঙ্গদাস নামক জনৈক ব্রাহ্মণের বাড়িতে তাঁহাকে লইয়া গেল। সেই ব্রাহ্মণের স্ত্রী শ্রীরঙ্গমে যাইয়া আচার্যের নিকট পূর্বেই দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি অসম্ভাবিত রূপে গুরুদেবকে গহে উপস্থিত দেখিয়া, প্রাণপণ যত্নে তাঁহার সেবা করিতে লাগিলেন।

আগুন কখনও লাকাইয়া রাখা যায় না। আচার্য দেবের আগমন বার্তা, সেই দেশে, অল্প দিন মধ্যে, চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। তাঁহাকে দর্শন করিতে ও উপদেশ শ্রবণ করিতে, সকল শ্রেণীর লোক, দলে দলে, তাঁহার নিকট আসিতে লাগিল। তিনিও স্থান হইতে স্থানান্তরে যাইয়া, ভগবদ ভক্তি প্রচার করিতে লাগিলেন। বিশেষ আগ্রহান্বিত অনেকে তাঁহার নিকট বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হইল।

আচার্যদের দ্বাদশ বৎসর ঐ অঞ্চলে ছিলেন। সেই দেশের লোককে উদ্ধার করিবার জন্যই যেন, ভগবানের ইচ্ছায় তিনি নির্বাসিত হইয়াছিলেন। তাঁহার চরিত্র প্রভাবে লোক সদাচার, সত্যনিষ্ঠা, ভগবানের উপাসনা প্রভৃতি সদগণের অনুশীলন করিয়া যথার্থ মনষ্যত্ব লাভ করিল। 


(8) 

প্রত্যাবর্তন

জ্ঞানিগণ বলেন, পূর্ব কর্মফলে জীব সখ দঃখ ভোগ করে। কবে যে এই কর্ম আরম্ভ হইয়াছিল, কেহ তাহা জানিতে পারে না। পূর্বে পূর্ব জন্মে কত কর্মের কতক অংশ ভোগ করিবার জন্য, জীব একটি দেহ ধারণ করে। আবার সেই জন্মে কৃত কর্মের ফল তৎক্ষণাৎ ভোগ হয় না, তাহা সঞ্চিত থাকে ; পরে কোনও জন্মে জীব সেই কর্মের ফল ভোগ করে। কিন্তু কোনও উৎকট পাপ বা পণ্যে করিলে, তাহার ফল এই জন্মেই ভোগ করিতে হয়।

দৃষ্টে কৃমিকণ্ঠ, নিরীহ, নিরপরাধ, জগতের মঙ্গলকারী মহাপুরুষগণকে যাতনা দিয়া যে মহাপাপ করিল, তাহার ফলে তাহার গলায় এমন বিষম ঘা হইল যে, তাহাতে কৃমিগণ কিলবিল করিতে লাগিল। লোকে তাহার নাম উচ্চারণ করিতে ঘৃণা বোধ করিত। কুমিকণ্ঠ নামে সে পরিচিত হইল। অসহনীয় যাতনা ভোগ করিয়া সে দেহত্যাগ করে।

কৃমিকণ্ঠের দুকার্যে তাহার আত্মীয়গণও উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। বিশেষতঃ তাহার ভীষণ পরিণাম দেখিয়া সকলেই ভাঁত হইলেন। তাহার মৃত্যুর পর, তাহার পত্র সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, পরম সমাদরে সশিষ্য আচার্য দেবকে শ্রীরঙ্গমে ফিরিয়া আসিতে আহবান করিল।

চোল-রাজপত্রের আহবানে, আচার্যদের দক্ষিণাঞ্চল হইতে শ্রীরঙ্গমে ফিরিয়া আসিতে প্রস্তুত হইলেন। এই সংবাদ পাইয়া, যাদবাদ্রির ভক্তগণ তাঁহার বিরহ-ভয়ে বড়ই কাতর হইয়া পড়িলেন। আচার্যদেবের অভাব কিয়ৎ- পরিমাণে দূর করিবার জন্য, তাঁহারা তাঁহার এক অবিকল মূর্তি নির্মাণ করিয়া রাখিলেন।

দ্বাদশ বৎসর পরে আচার্যদেব আবার শ্রীরঙ্গমে ফিরিয়া আসিলেন। এই কয়বৎসরে, শ্রীরঙ্গমের অবস্থা অতি শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে। দুষ্টে রাজার ভয়ে বৈষ্ণবগণ শ্রীরঙ্গম ত্যাগ করেন। শুধু দেব-সেবকগণ, অতি কষ্টে, শ্রীরঙ্গনাথের সেবা চালাইতে ছিলেন। ছিল। নগরটি যেন অরণ্যে পরিণত হইয়া- এখন আচার্যদেব ফিরিয়া আসিয়াছেন, এই সংবাদ পাইয়া বৈষ্ণবগণ যে যেখানে ছিলেন, সকলেই, পরম উৎসাহে, শ্রীরঙ্গমে আসিয়া সমবেত হইলেন। ক্রমে পথঘাট ও মঠ মন্দিরের সংস্কার করা হইল। নগরটি পূর্বের ন্যায় আবার উৎসবময় হইয়া উঠিল। 

(৫)

কুরেশের চক্ষ, লাভ

কাহারও কাহারও মতে, নরেশ রামানন্দজের বেশে রাজসৈন্য কর্তৃক ধৃত হইলে, আচার্যের শিযাবৎসল জ্বর, ১০০ বৎসর ব্যাক অতিবৃদ্ধ মহাপূর্ণ ও তাঁহার সঙ্গে যোগদান করেন। ঘাতকগণ তাঁহারও চক্ষু উৎপাটিত করে ; তাহাতেই তাঁহার দেহত্যাগ হয়। ঘাতকগণ কুরেশকে শ্রীরামে পাঠাইয়া দেয়; কিন্তু রাজার ভয়ে মন্দিরের পূজারীগণ তাঁহাকে তথায় স্থান দিলেন না। রেশ বষভাদ্রি নামক স্থানে যাইয়া ইস্ট চিন্তায় মগ্ন হইলেন। আচার্য - দেব শ্রীরামে আসিয়াই সর্বপ্রথম করেশকে ডাকিয়া আনাইলেন। তাঁহাকে রাজার অত্যাচার হইতে রক্ষা করিতে গিয়া করেশের এই দুর্দশা আচার্যদেবের অসহনীয় বোধ হইতে লাগিল। তিনি একদিন করেশকে আদেশ করিলেন, "বংস, তুমি কাঞ্চীপুরীতে গিয়া, শ্রীবরদরাজের চরণে চক্ষুর জন্য প্রার্থনা জানাও।” গল্পে গতপ্রাণ করেশ গুরুর আদেশমতো, কান্ত পরে গেলেন বটে, কিন্তু, বরদরাজের মন্দিরে প্রবেশমার প্রেমে বিভোর হইয়া, চক্ষু, ফিরিয়া পাইবার প্রার্থনা করিতে পারিলেন না। বর চাহিলেন, যে ঘাতক তাঁহার চন্দ্ উৎপাটন করিয়াছিল, সে যেন মুক্তি পায়। কারেশ গরুর নিকট ফিরিয়া গিয়া এই ঘটনা নিবেদন করিলে আচার্যদেব তাঁহাকে আবার চক্ষু প্রার্থনা করিতে কাঞ্চী পাঠাইলেন। তিনি এবারও গুরুর আদেশ রক্ষা করিতে অসমর্থ হইলেন জ্ঞান-ভক্তি ক্তদাতার নিকট ক্ষণস্থায়ী চক্ষুর জন্য প্রার্থনা করিতে তিনি অত্যন্ত লজ্জাবোধ করিতে লাগিলেন। তিনি এবারও প্রার্থনা করিলেন, কৃমিকন্ঠ যেন মন্তি লাভ করে। শুনিয়া আচার্য দেব তাঁহাকে আদেশ করিলেন, “বৎস, এইবার কিন্তু আমার আনন্দের জন্য, তুমি আমার আদেশ রক্ষা কর। আবার যাইয়া ‘গরুর আদেশে চক্ষু, ভিক্ষা করিয়া লও।” গুরুেবাক্যের মান রক্ষা করিবার জন্য, এবার করেশ চক্ষু, প্রার্থনা করিলেন। প্রার্থনা শেষ হইতে না হইতে করেশের দৃষ্টিশক্তি পূর্ববং সম্পূর্ণ প্রকাশিত হইল ।

এই আশ্চর্য ঘটনা দেখিয়া, ঘোর অবিশ্বাসীও ভক্ত ও ভক্তির মহি বিশ্বাস লাভ করিয়া ধন্য হইল। 


(৬)

 অন্ত্যলীলা

আচার্য দেবের বয়স এখন ষাট বৎসর। তাঁহার অসাধারণ কার্যসমূহ দেখিয়া তাঁহাকে সকলেই দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করিতে লাগিল । তাঁহার অনাগ্রহে সহস্র সহস্র লোক জ্ঞান-ভক্তি লাভ করিয়া ধন্য হইল। শ্রীরঙ্গম স্বর্গতুল্য আনন্দময় হইয়া উঠিল।

সম্প্রদায়ের বৃদ্ধ ভক্তগণ ক্রমে ক্রমে দেহত্যাগ করিতে লাগিলেন। পরাশর, বেদব্যাস ও পূর্ণাচার্য প্রভৃতি তর গগণকে আচার্যদেব নিজে শিক্ষা দিয়া সঙ্ঘ পরিচালনে উপযুক্ত করিয়া তুলিলেন। তাহাদের মধ্যে পরাশরকে বিপুল বৈষ্ণব সম্প্রদায় শাসনে সমর্থ বিবেচনা করিয়া, সমাজের নায়ক পদে প্রতিষ্ঠিত করিলেন।

নির্বাসন হইতে ফিরিয়া আসিয়া, তিনি আরও ষাট বৎসর জীবিত ছিলেন। এই সময়ের ঘটনার বিবরণ কিছুই জানা যায় না। তবে, অন্যান্য মহাপুরুষ- দের কার্যাবলী আলোচনা করিয়া আমরা কতকগুলি বিষয় অনুমান করিতে পারি। দেখা যায়, কোনও দেশে মহাপুরুষ জন্ম গ্রহণ করিলে, তাঁহার প্রবল চিন্তা-তরঙ্গ প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত করিয়া তাহাদের অন্তরের সপ্ত সৎপ্রবৃত্তিগুলি জাগাইয়া তুলে। তখন কর্মীর কর্ম, চিন্তাশীলের চিন্তা, শধু, কল্যাণের পথেই চালিত হইতে থাকে। দেখা যায়, মহাপুরষ- গণেরও তাঁহাদের শিষ্যান শিষ্যগণের চরিত্রের সৌন্দর্য ও ঈশ্বরানভে‚তির আনন্দ লক্ষ্য করিয়া, অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়, দলাদলির ভাব ছাড়িয়া, নিজ নিজ সাধনায় অধিকতর মনোযোগী হইয়া থাকে । এমন কি, ধর্ম-সাধকদের উৎসাহ, সংক্রামক হইয়া, শিল্প, সাহিত্য, বাণিজ্য প্রভৃতি সংসারের কাজে কর্মীদের কর্মশীলতা বৃদ্ধি করে। এই রূপে মহাপুরুষদের আগমনে মানবসমাজের উন্নতির সকল রুদ্ধ-ম্বার খুলিয়া যায়।

আচার্য শঙ্করের পর, ভারতবাসীর জীবনে আচার্য রামােেজর আদর্শের প্রভাব অসামান্য ও অতি গভীর। 


(9)

দুইটি কাহিনী

মানুষের ভক্তি বিশ্বাস কত বিচিত্ররূপে যে আত্ম-প্রকাশ করে, নিম্ন-

লিখিত ঘটনা দুইটি তাহার নিদর্শন।

(ক)

একজন সরল ব্রাহ্মণ, আচার্যের নিকট একদা তাঁহার কোনও প্রকার সেবা করিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। আচার্যদেব তাঁহার নিকট এইরূপে একটি অদ্ভূত প্রস্তাব করেন যে, তিনি নিত্য সন্ধ্যা-পূজার পূর্বে, ব্রাহ্মণের পাদোদক পান করিতে চান; প্রতিদিন পাদোদক দিলে, তাঁহার সব চেয়ে বেশি সেবা করা হইবে। সরল ব্রাহ্মণ তাহাতেই সম্মত হইলেন; আচার্য দেবকে নিত্য নিজ পাদোদক দেওয়া তাঁহার একটি ব্রত হইল।

একদিন আচার্যদেব নিমন্বিত হইয়া, এক ভক্ত গৃহে সমস্ত দিন যাপন করেন। রাত্রি এক প্রহরের সময়, মঠে ফিরিয়া আসিয়া তিনি জানিতে পারিলেন যে, উক্ত ব্রাহ্মণটি, আজ পাদোদক দিয়া সেবা করিতে না পারায়, নিরাহারে সারাদিন তাঁহার অপেক্ষায় বসিয়া আছেন। আচার্যদেব ব্যস্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহার পাদোদক গ্রহণ করিলেন ; তখন ব্রাহ্মণ, দিবসের কর্তাব্য শেষ হইল ভাবিয়া, গৃহে ফিরিলেন। এইরূপে নির্বিচার সেবার ভাব ও কর্তব্যনিষ্ঠা বড়ই দলাভ।

(খ)

 একদিন একটি গোপ-বালিকা দধি বিক্রয় করিতে মঠে আসে। দধি ক্রয় করিয়া মূল্য দিতে একটা বিলম্ব হওয়াতে বালিকা তথায় অপেক্ষা করিতে- ছিল। এই সময় তাহাকে কিছু, প্রসাদ খাইতে দেওয়া হয়। সাধু,দিগকে, বিশেষতঃ আচার্য দেবকে দেখিতে দেখিতে তাহার মনে হঠাৎ একটা অদভূত ভাবের উদয় হইল। সে দধির মূল্য লইতে অসম্মত হইল এবং তাহাকে মুক্ত করিয়া দিবার জন্য আচার্যদেবকে মিনতি করিতে লাগিল। তাহার ছেলেমানুষি দেখিয়া, অনেক প্রকারে বুঝাইলেও সে কিছুতেই নিরস্ত হইল না। বালিকা ক্রমেই যেন আরও ব্যাকল হইয়া উঠিতে লাগিল । কখন কখন দেখা যায়, পূর্ব জন্মের সংস্কার, কোন একটি সামান্য অনুকূল ঘটনা অবলম্বনে হঠাৎ জাগিয়া উঠে । সাধরা ভাবিলেন, প্রসাদ ভক্ষণের ফলে ইহার পূর্বে সংস্কার এইরূপ প্রবল হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছে।

তাহাকে কিছুতেই শান্ত করিতে না পারিয়া, আচার্যদেব বলিলেন যে, বেঙ্কটাচলে নারায়ণের নিকট গেলেই বালিকার মনোবাসনা পূর্ণ হইবে। আচার্যের উপর তাহার পূর্ণ বিশ্বাস ; সে বলিল, “তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিবেন কেন! আপনি পত্র লিখিয়া দিন, আমি তাহা লইয়া নারায়ণের নিকট যাইব।” বালিকার সরলতায় মুগ্ধ হইয়া, আচার্যদেব এক পত্র লিখিয়া দিলেন।

কয়েক দিন পরে, সকলে শনিয়া আশ্চর্যান্বিত হইলেন যে বালিকা বেঙ্কটাচলে গিয়া নারায়ণের সম্মুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিতে যে মাটিতে পড়িয়াছিল, আর উঠে নাই; সমাধি যোগে তাহার দেহত্যাগ হইয়া গিয়াছে। কঠোর সাধনায়ও যাহা লাভ করা স,কঠিন, শখ, বিশ্বাসের বলে, একটি মূর্খ বালিকা তাহা লাভ করিল।


(৮)

দেহত্যাগ

আচার্যদেবের বয়স ১২০ বৎসর পূর্ণ হইল। তিনি শীঘ্রই দেহত্যাগ করিবেন বুঝিতে পারিয়া, ভক্তগণ শ্রীরঙ্গমে একটি ও ভূতপরীতে একটি, তাঁহার এই দুইটি মূর্তি স্থাপন করিলেন।

দেহত্যাগের দুই এক দিন পূর্বে, তিনি তাঁহার প্রচারিত ধর্মের সারমর্ম, সংক্ষেপে, সমবেত শিষ্যগণকে বুঝাইয়া দিলেন। ১১৩৭ খৃষ্টাব্দে (শকাব্দ ১০৫৯), মাঘ মাসের শুক্লা দশমীর মধ্যাহ্ন কালে, গোবিন্দের কোলে মস্তক এবং আন্ধুপর্ণের কোলে চরণদ্বয় রাখিয়া আচার্যদেব মহাসমাধি অবলম্বন করিলেন।

তাঁহার স্থূল দেহ পঞ্চভূতে মিশিয়া গেল ; কিন্তু, মানবজাতির সম্মুখে তিনি যে মহান আদর্শ রাখিয়া গেলেন, তাহা চিরকাল মানুষকে কল্যাণের পথ প্রদর্শন করিবে।



RJKB

RJKB stands for Raja Jnana Karma Bhakti. In this blogger site, you will get many more life building thoughts which will increase your Spiritual Power. So join this blog & start your Spiritual Journey. আর জে কে বি মানে রাজ জ্ঞান কর্ম ভক্তি। এই ব্লগার সাইটে, আপনি আরও অনেক জীবন গঠনের চিন্তা পাবেন যা আপনার আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করবে। সুতরাং এই ব্লগে যোগ দিন এবং আপনার আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করুন।

Post a Comment

Previous Post Next Post