।। রামানুজ চরিত ।। Ramanuj Charit ।। #চতুর্থ অধ্যায়


(১)

ধর্ম সংস্থাপন

সাধনা, গ্রন্থ-রচনা ও প্রচার, এই তিনটি প্রধান উপায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান রক্ষা করা হয়।

১। সাধনা, সাধনা না করিলে কোন প্রকার জ্ঞানই লাভ করা যায় না। যেমন, অঙ্ক শিখিতে হইলে, উহা শিখিবার যে নির্দিষ্ট প্রণালী আছে তাহা দীর্ঘকাল অভ্যাস করিতে হয়। সকল প্রকার জ্ঞান লাভের পদ্ধতিই এইরূপে। যে জ্ঞান যত গভীর, তাহার সাধনাও তত কঠোর। বিজ্ঞান সমূহে আবিষ্কৃত সত্যগুলি কত প্রাণপাতী সাধনার ফল। সাধনা করিয়া প্রত্যক্ষ না করিলে, কোনও জ্ঞানই কাজে লাগে না, কথার কথা মাত্র হইয়া পড়ে। বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ ফল আমরা নিত্য দেখিতেছি বলিয়া, বিজ্ঞানকে আমরা এত ভালবাসি এবং বিশ্বাস করি।

ধর্ম ও একটি বিজ্ঞান। তাহার নির্দিষ্ট সাধন-পদ্ধতি অবলম্বন করিলে নিশ্চিত রূপে জানিতে পারা যায় যে, (১) দেহ মানুষের বহিরাবরণ মাত্র, মৃত্যু কালে তাহা খসিয়া পড়ে এবং মানষটি যেমন ছিল তেমনই থাকে : ( ২ ) মানুষ পূর্ব পূর্ব জন্মে যে সব কাজ করে, পর জন্মে তাহার ফল ভোগ করিবার জন্য, বার বার জন্ম গ্রহণ করে; (৩) তাহার সুখ ও দুঃখের কারণ পূর্বকৃত সৎ ও অসৎ কর্ম ; (৪) ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হইলে মানুষের সকল প্রকার অজ্ঞান, দূর্বলতা ও অপূর্ণতা চলিয়া যায়, ইত্যাদি।

এই সকল সত্য প্রত্যক্ষ অনুভব করিলে, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি অসদ, পায়ে স্বার্থসাধনের কিছুমাত্র প্রয়োজন তো থাকেই না, পরন্তু মানুষ জিতেন্দ্রিয় ও পরার্থপর হইয়া থাকে। বুদ্ধে, শঙ্কর, রামান,জ, নানক, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ প্রভৃতি মহাপুরুষগণ নিজে সাধন করিয়া এই সব সত্য প্রত্যক্ষ অনুভব করেন। এবং তাঁহাদের শিক্ষাদিগকে অনুভব করাইয়া দেন। তাহার ফলে, তাঁহাদের পরবর্তী ভারতীয় সমাজ প্রভূত উন্নতি লাভ করিয়াছে। অপর পক্ষে, যখন যে মানব সমাজ ধর্ম-বিজ্ঞান সাধনা পরিত্যাগ করে, সেই সমাজের লোক পরকালে বিশ্বাস হারায় এবং লোভ-মোহের বশে পাপ- গুণের বিচার করিতে অসমর্থ হইয়া পশতুল্য হিংস্র হইয়া উঠে। ইহার প্রমাণ বর্তমান জগতে সর্বত্র পরিলক্ষিত হইতেছে।

সাধনাই সর্বপ্রকার জ্ঞান রক্ষার প্রধান উপায়।

২। গ্রন্থ রচনা,—জ্ঞানী নিজের অনভূত সত্য নিজে লিখিয়া রাখিলে, মূর্খের সংস্কার তাহাতে মিশিতে পারে না এবং প্রবণ্যকগণ জ্ঞানীর নাম করিয়া নিজের অসদভিসন্ধিপূর্ণ মত অন্ততঃ শিক্ষিত লোকের নিকট প্রচার করিতে সাহস করে না।

প্রচারের অর্থাৎ অন্যকে শিখাইবার ব্যবস্থা না থাকিলে, সকল প্রকার জ্ঞানই কালে বিলপ্ত হইয়া যায়। তাই বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া জ্ঞান রক্ষার ব্যবস্থা হইয়া থাকে। আর, জ্ঞান সর্বত্র প্রচার করিলে, বহু লোকের বিচার বিতর্ক ও সমালোচনার ফলে তাহাতে ক,সংস্কার প্রবেশ করিতে পারে না। বহ, দেশে, বহ, স্থলে, যে বিষয়ের আলোচনা হয়, তাহা সহজে নষ্ট হয় না। অতি প্রাচীনকাল হইতে, জ্ঞানিগণ, এই তিন উপায়ে সকল প্রকার জ্ঞান- বিজ্ঞান রক্ষা করিয়া আসিতেছেন। আচার্যদেব এই তিনটি উপায়ই অবলম্বন

করিয়াছিলেন।

প্রথমতঃ আচার্য দেব ও তাঁহার শিষ্যগণ, কঠোর সাধনা করিয়া, মন হইতে হিংসা-দ্বেষ, অভিমান-অহঙ্কার এবং কাম কোব প্রভর্তি মলিনতা দূর করিলেন। তাঁহাদের মহত্ত্ব, তেজস্বিতা, মঞ্জুর চরিত্র ও অসামান্য মানসিক শক্তি দেখিয়া, তাঁহাদিগকে আদর্শ মানুষ বলিয়া সকলেই ভক্তি করিতে লাগিল এবং তাঁহাদের অনুকরণ করিয়া সখী হইল ।

দ্বিতীয়তা, তিনি নিজে, নিজ অনভতে সত্য বুঝাইবার জন্য, অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁহার শিষ্যগণও এই মত রক্ষার জন্য, অনেক গ্রন্থ লিখিয়াছেন।

তৃতীয়তঃ, এই জ্ঞান রক্ষার জন্য, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্বরূপ একটি সাধক- সম্প্রদায় গঠন করেন। মঠ আশ্রমে এবং শ্রীরাম ও কাঞ্চী প্রভৃতি দেব-স্থানে, শাস্ত্র আলোচনার ব্যবস্থা করিয়া, আচার্যদেব যে প্রচার কার্য আরম্ভ করিয়া দিয়া যান, তাহা সহস্র বৎসর যাবৎ এখনও অব্যাহত ভাবে চলিয়া আসিতেছে। নিজে সর্বত্র যাইয়া, তর্ক বিচার ও ব্যাখ্যা করিয়া, নিজের মত স্থাপন করিলে, শীঘ্রই তাহা ছড়াইয়া পড়ে। সেই জন্য আচার্য শঙ্করের ন্যায়, আচার্য" রামানুজেও ব্যাপক ভাবে ভারতের সর্বত্র স্বীয় মত প্রচার করা কর্তব্য মনে করিয়াছিলেন।

(2)

দিগ বিজয়

আচার্যদেব শ্রুতিধর করেশ ও সর্বশাস্ত্রজ্ঞ দাশরথি প্রভৃতি প্রধান প্রধান শিযাগণকে সঙ্গে লইয়া ধর্ম প্রচারে বাহির হইলেন। তিনি প্রথমে শ্রীরলামে রঙ্গনাথকে, কাঞ্চীতে শ্রীবরদরাজকে এবং পেরেমবন্দরে আদি-কেশবকে দর্শন করিয়া তাঁহাদের আশীর্বাদ গ্রহণ করিলেন ; অতঃপর, দক্ষিণ দিকে রামেশ্বর পর্যন্ত সর্বত, পণ্ডিতদের সঙ্গে শাস্ত্রবিচার করিয়া, তাঁহাদিগকে নিজ মত লওয়াইলেন এবং সর্বসাধারণকে ভক্তি দানে কৃতার্থ করিলেন।

ঐ দিকের ব্রাহ্মণগণ তখন বিষম গোঁড়া। দক্ষিণে কোন কোন জাতির

লোকের মুখ দেখিলেই ব্রাহ্মণরা অপবিত্র হইয়া যাইতেন; কোন কোন লোকের

সলো এক রাস্তায় চলাও তাঁহাদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। আচার্যদেব সন্ন্যাসী

হইলেও ব্রাহ্মণ কালে জন্মিয়াছিলেন এবং যে সব সন্ন্যাসী শিষ্য তাঁহার সঙ্গে

ছিলেন, তাঁহারাও ছিলেন ব্রাহ্মণ জাতীয়। তাই অভ্যাসবশতঃ, ছৎ-মার্গের

কিছু, সংস্কার তাঁহাদের মধ্যে থাকা কিছু, অবাভাবিক ছিল না। তাই কি,

ভগবানের ইচ্ছায়, নিম্নলিখিত ঘটনাটি ঘটিয়াছিল।

তির,ভেলীতির, নগরীর পথে, একদিন এক নিচ জাতীয় রমণীর সহিত আচার্যদেবের সাক্ষাৎ হয়। তিনি দূর হইতে তাহাকে দেখিয়াই, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তাহাকে রাস্তা ছাড়িয়া সরিয়া যাইতে বলিলেন। সে উত্তর দিল, "সব দিকেই দেবতার মন্দির যে দিকেই যাইব, স্থান অপবিত্র হইবে : এখন কোন দিকে যাইব, আপনি বলিয়া দিন।" রমণীর কথা শুনিবা মাত্র, রামানুজ, সমস্ত জগৎ বিষ্ণু ময় দেখিয়া, লজ্জিত হইলেন এবং রমণীকে নমস্কার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন।

আচার্যদেব সেতুবন্ধ রামেশ্বর হইতে ভারতের পশ্চিম উপকূল দিয়া, উত্তর মুখে তীর্থ-পরিক্রমা ও ধর্মপ্রচার করিতে করিতে হিমালয়ে বদরীনারায়ণ প্রভৃতি দর্শন করিয়া কাশ্মীরে উপস্থিত হইলেন এবং তথাকার পণ্ডিত দিগকে বিচারে পরাস্ত করিয়া বিশিষ্টাদ্বৈত মত প্রচার করিলেন। এইরূপে, উত্তর ভারতের অন্যান্য প্রসিদ্ধ নগরীতে বৈষ্ণব মত প্রচার করিয়া পুরীধাম হইয়া, তিনি শ্রীরামে ফিরিয়া আসিলেন।

সমগ্র ভারতে বৈষ্ণব মত প্রচার করিয়া আচার্যদেব শ্রীরামে ফিরিয়া আসিলে, বৈষ্ণবদের আনন্দের সীমা রহিল না। বৈষ্ণব পর্ব' উপলক্ষে, উৎসবের আড়ম্বর খুব বাড়িয়া গেল। সমস্ত দেশের লোক সর্বদা আচার্য দেবের চরিত- কথা ও উপদেশসমূহে আলোচনা করিয়া, ধন্য হইতে লাগিল।

(3)

রামানুজের ধর্ম

মহাপুরুষদের প্রচারিত ধর্মমত বুঝিতে হইলে, তাঁহাদের সমসাময়িক লোক- সমাজের মানসিক অবস্থা ভালরূপে জানা প্রয়োজন। তাহা না জানিলে মনে হইবে, তাঁহাদের জ্ঞান বুঝি অসম্পূর্ণ ছিল, তাই এক একজন এক এক দিকে বকেয়া পড়িয়াছিলেন বোধ হইবে। যেমন, কেহ কেহ বলেন, শ্রীকৃষ্ণ কর্মের, বদ্ধদেব সন্ন্যাসের, শঙ্করাচার্য জ্ঞানের এবং আচার্য রামানজে ও চৈতন্যদেব ভত্তির গোঁড়া ছিলেন। ইহারা সকলেই ভগবানের আদেশে ধর্ম প্রচার করিয়া ছিলেন। সুতরাং, ইহাদের শিক্ষায় ভ্রম থাকিতে পারে না। তবে ইহারা এক এক দিকে এত জোর দিয়াছেন কেন? তাহার সস্পষ্ট কারণ এই যে, মানুষের যখন যে ভাবের যত বেশি অভাব হয়, মহাপুরুষগণ সেই ভাবের দিকে তাঁহাদের মন তত বেশি আকর্ষণ করেন।

শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, যদি মুক্তি চাও, তবে নিষ্কাম ভাবে কর্ম কর। কিছ দিন যাইতে না যাইতে, মানুষ মুক্তির কথা ভুলিয়া গেল আর নিষ্কাম হইতে যাইয়া, উদ্দেশ্য-হীন কর্ম করিতে লাগিল—যাহাকে বলে, ভূতের বেগার 'খাটা। তখন ধর্মের ক্রিয়া ছিল, কিন্তু ধর্ম'চিন্তা' ছিল না। বৃদ্ধদেবকে বাধ্য হইয়া ঐ চিন্তাহীন কর্মের ধর্মকে একেবারেই পরিত্যাগ করিতে হইল। তিনি চিন্তার ধর্ম প্রচার করিয়া, মানুষকে জড়ত্ব প্রাপ্তি হইতে রক্ষা করিলেন। পরবর্তী কালে লোকে, বৃদ্ধদেবের দোহাই দিয়া মুখে নির্বাণ নির্বাণ বলিলেও, কার্যতঃ সকল বিষয়ে কেবলই সংসারভোগের ব্যবস্থা করিত। নির্বাণ মমুক্তি তো দূরের কথা, পরকালের ভয়-ভাবনাও তাহারা ভুলিয়া গিয়াছিল। তাহার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মারিল ভট্ট বেদের কর্মকাণ্ডের উপর অত্যন্ত ঝোঁক দিলেন। তাহাতে কদাচার নিবৃত্ত হইল; লোকে ধর্মপথে চলিতে এবং ইহ-পরকালের মঙ্গল চিন্তা করিতে শিখিল। কিন্তু চিন্তাশীল লোকেরা আচার ও কর্ম প্রধান ধর্মে তুষ্ট হইতে পারিলেন না। ধর্ম সম্বন্ধে নানা প্রকার সংশয় তাঁহাদের মনকে পীড়িত করিতে লাগিল। তখন আচার্য' শঙ্কর অবতীর্ণ হইয়া চিন্তাশীলদের জন্য বৈদিক জ্ঞানযোগ ও সর্বসাধারণের জন্য বর্ণাশ্রম ধর্ম প্রচার করিলেন। এই উভয়ের প্রচারের ফলে, বৌদ্ধ বিপ্লবে যে যথেচ্ছাচার দেশে আসিয়াছিল, তাহা দূর হইল।

বৈদিক বিধানে কর্ম' অতি অল্প লোকই করিতে পারে এবং জ্ঞানযোগ অভ্যাস করিবার অধিকারী সংসারে দুর্লেভ। সতরাং মারিল ও শঙ্কর প্রচারিত ধর্ম উচ্চবর্ণের ও উচ্চশিক্ষিতের ধর্ম হইয়া রহিল; সর্বসাধারণের তাহাতে বিশেষ উপকার হইল না। দেখিতে দেখিতে, আবার সমাজে বিপ্লব উপস্থিত হইল। জ্ঞানযোগের কথা আলোচনা করিলে একপ্রকার আনন্দ হয় ; কিন্তু ঐ যোগ অভ্যাস করিয়া ফল প্রত্যক্ষ করা অত্যন্তই কঠিন। সেই কঠিন পথে কেহ প্রায় চলিতে চাহিত না; কেবল কতকগুলি মত জানিয়াই নিজেকে জ্ঞানী মনে করিয়া অহঙ্কারে মত্ত হইত। তাহারা মানলাভের জন্য জ্ঞানীর ভান করিয়া লোকের নিকট প্রচার করিত যে, একমাত্র ব্ৰহ্মই সত্য এই জগৎ একান্ত মিথ্যা। এই কথার অর্থ কেহ না বুঝিলেও, ভক্তি উপাসনা, ধর্মকর্ম, ভগবান, পরকাল, স্বর্গ-নরক, সবই মিথ্যা মনে করিয়া, ঐ সব বিষয়ে মাথা ঘামাইত না; যথেচ্ছভাবে জীবন যাপন করাই কর্তব্য ভাবিত। এই সময়ে আচার্য রামাজে জ্ঞান ও কর্মের সহিত ভক্তি মিশাইয়া সর্ব মানবের উপযোগী এক ধর্মমত প্রচার করিলেন। তাহার ফলে সর্বগ্রাহী বৈদিক ধর্ম" আপন মহিমায় সমগ্র ভারতে প্রতিষ্ঠিত হইল।

রামাজে প্রচার করিলেন, ভগবান পরম করুণাময়, সর্বব্যাপী এ সকল গুণের আধার। জীব তাঁহার অংশ। অন্যায় কর্ম করাতে জীবের স্বরূপ- জ্ঞান নষ্ট হইয়া যায় বলিয়া, সে ঈশ্বরকে জানিতে পারে না। ভক্তির সহিত উপাসনা করিলে, সে নিজের ও ঈশ্বরের স্বরূপ ও পরস্পর সেব্য-সেবক সম্বন্ধ জানিতে পারে। তখন, তাহার আর জন্ম হয় না এবং মৃত্যুর পর, সে, পরম আনন্দে, চিরকাল, নারায়ণের নিকট বাস করে। এই ধর্মে সকলের সমান অধিকার ; তবে, খুব পবিত্র ভাবে থাকিতে হয়; আহার বিহারে শাস্ত্রের নিয়ম সর্বতোভাবে মানিয়া চলিতে হয়।

রামানন্জ ও তাঁহার শিষ্যগণের মহৎ চরিত্র, ত্যাগ ও তপস্যা প্রভাবে ভারতে এক সর্বব্যাপী ভক্তির আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল। পরবর্তী কালে, অধিকাংশ আচার্য ভক্তিমূলক ধর্ম প্রচার করিয়া, ভারতবর্ষকে ধর্ম বিষয়ে এখনও জগতের শিক্ষার স্থল করিয়া রাখিয়াছেন।

(8) 

ধনুর্দাস

শ্রীরঙ্গমে মহোৎসব। বহু স্থানের শত শত লোক মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত হইয়াছে। একজন অসামান্য সন্দরী রমণী উৎসব ক্ষেত্রে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। আর সর্বাপেক্ষা বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করিল ঐ রমণীতে আসক্ত জনৈক যুবক। সে মেয়েটির মাথায় ছাতি ধরিয়া, দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া, তাহার মুখের পানে চাহিয়া চাহিয়া, সঙ্গে সঙ্গে ফিরিতেছিল। এই অদ্ভুত দৃশ্য যেন জন-সমুদ্রকে বিক্ষুব্ধ করিয়া তুলিল। ইহা আচার্য - দেবেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। তিনি, জনৈক সেবক পাঠাইয়া, যুবকটিকে ডাকাইয়া আনিলেন। তারপর, তাঁহাদের দুই জনের মধ্যে নিম্নলিখিত কথা- বার্তা হইল।

রামানাজ—তুমি, ঘণা লজ্জা ত্যাগ করিয়া এই রমণীর সঙ্গে এইরূপ ঘুরিতেছ কেন?

যবেক—আমি ইহার চোখে এমন এক সৌন্দর্য দেখি, যাহার সঙ্গে জগতের আর কোন রূপের তুলনা হয় না। ইহার চোখ দেখিলে আমি জগৎ জ্বলিয়া যাই।

রামানুজে— আমি যদি তোমার স্ত্রীর চোখ হইতে আরও সন্দের চোখ

দেখাইতে পারি, তবে তুমি তাহা আরও বেশি ভালবাসিবে?

যবেক—প্রভ,, আমার স্ত্রীর চোখ অপেক্ষা বেশি সন্দের চোখ আছে বলিয়া মনে হয় না। যদি আপনি তেমন চোখ দেখাইতে পারেন, তবে অবশ্যই তাহা আমার বেশি ভাল লাগিবে।

রামানুজে— আচ্ছা, তুমি আজ সন্ধ্যায় আবার আমার সঙ্গে দেখা করিও। লোকটির নাম দাস, সে ছিল মরবিদ্যায় নি। আর, লোকটির নাম হেমামা। ধনদাস সত্য সত্যই সন্ধ্যাকালে আচার্য দেবের নিকট উপস্থিত হইল। তিনি তাহাকে লইয়া মন্দিরে আরাত্রিক দর্শন করিতে গেলেন। আরতি দেখিতে দেখিতে তন্ময় হইয়া, ধনদাস রঙ্গনাথের চোখে এমন অলৌকিক সৌন্দর্য দেখিতে পাইল যে, আনন্দে তাহার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল; আর চোখ হইতে অবিরল ধারায় অশ্রুপাত হইতে লাগিল। রামানন্দজের কৃপায় এইরূপে দুর্লভ দেব-দর্শ'ন লাভ করিয়াছে বুঝিতে পারিয়া, সে তাঁহার চরণে শরণ নিল। তাহার স্ত্রী হেমাম্বাও আচার্য দেবের শিষ্যা হইল।

এই প্রেমিক প্রেমিকা অল্পকাল মধ্যেই ভগবানের ভাবে তন্ময় হইয়া গেল। আচার্যদেবও তাহাদিগকে খুব স্নেহ করিতে লাগিলেন। এই হীন জাতীয় সম্পত্তির উপর তাঁহার স্নেহাধিকা, সন্ন্যাসী শিয্যগণের ভাল বোধ হইল না। এই বিষয় নিয়া বেশ একটা সমালোচনা হইতে লাগিল । আচার্য নীরব থাকিয়া, শিষ্যদের বৃদ্ধি সংশোধন করিবার সংযোগের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

একদিন রাত্রে, আচার্যদেব গোপনে শিষ্যদের বহিবাস ছিড়িয়া রাখিলেন। পরদিন ভোরে, শিষ্যগণ নিজ নিজ বস্ত্রের এই দশা দেখিয়া, পরস্পরকে দোষী মনে করিয়া, বিষম কলহ করিতে লাগিলেন। অবস্থা এইরূপে দাঁড়াইল যে, আচার্যদেবকে স্বয়ং মাইয়া তাহাদিগকে নিরস্ত করিতে হইল।

দুইএক দিন পর, আচার্যদেব শিষ্যদের সঙ্গে পরামর্শ করিলেন যে, হেমাম্বা ও ধনদাস বড় ভক্তি ও ত্যাগের ভাব দেখায়, তাহা সত্য কিনা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে; হেমাম্বার অনেক স্বর্ণালঙ্কার আছে, তাহা গোপনে সরাইয়া লইয়া আসিলে তাহারা কি করে দেখা যাইবে। গুরুদেবের এই অদ্ভূত প্রস্তাবে শিষ্যগণ খুব আমোদ অনুভব করিলেন এবং তাহা কার্যে পরিণত করিতে পরম উৎসাহের সহিত প্রস্তুত হইলেন।

কয়েকদিন পর, একদিন আচার্য হেমাম্বাকে বলিলেন, "মা, তুমি তো দেহ-মন-প্রাণ ভগবানকে দিয়াছ; তোমার অনেক সোনার অলঙ্কার আছে, তাহা দ্বারা এই ভগবানের দেহ সাজাইয়া রাখ।” গল্পের আদেশে, ঘরে যা কিছু, অলঙ্কার ছিল সব পরিয়া, হেমাম্বা বেশ সাজিয়া গাজিয়া রহিল। সেই দিন মনন্ধ্যারতির পর ধনদোস আসিলে, গুরুদেব তাহার সঙ্গে অনেক ধর্মকথা বলিতে লাগিলেন। কথায় কথায় অনেক রাত্রি হইয়া গেল। স্বামীর বিলম্ব দেখিয়া হেমারা ঘুমাইয়া পড়িল। গুরুদেবের ইঙ্গিতে শিষ্যগণ হেমাবার ঘরের নিকট ছিলেন ; হেমাম্বা ঘুমাইতেছে দেখিয়া, তাহারা অতি সাবধানে তাহার অলংকারগুলি গুলিতে লাগিলেন। হেমা কাত হইয়া ইয়া ছিল; সে হঠাৎ অনুভব করিল যে, চোর তাহার অলঙ্কার চুরি করিতেছে। সে মনে মনে ভাবিল যে, গরু, কৃপা করিয়া অলংকারের বোঝা তাহার দেহ হইতে নামাইবেন বলিয়াই এই ব্যবস্থা বুঝি করিয়াছেন। তাই এক পাশের অলংকার খোলা হইয়া গেলে, অন্য পাশ ফিরাইয়া দিবার জন্য, যেন ঘুমের ঘোরে, সে পাশ ফিরিয়া শাইবার চেষ্টা করিল। শিষ্যগণ তাহাকে নড়িতে দেখিয়া, রস- ভঙ্গ হইবার ভয়ে পলাইয়া গেলেন। তাঁহারা আশ্রমে ফিরিয়া আসিলে, তাহাদের মাড়া পাইয়া আচার্যদেব ধর্মেসিকে বিদায় দিলেন।

ধনদাস চলিয়া গেলে,  শিষ্যগণ সহর্ষে অলংকারগুলি আনিয়া গুরুর সম্মুখে রাখিলেন। অলংকার চুরি হওয়াতে ধনদাস ও হেমাম্বাতে কিরূপ কথাবার্তা হয়, তাহা শনিবার জন্য, আচার্যদেব আবার শিষ্যদের প্রেরণ করিলেন। শিষ্যগণ আড়ালে থাকিয়া, ভক্ত দম্পতির কথাবার্তা শুনিতে লাগিলেন।

ধনদাস ঘরে ফিরিতেই, হেমাম্বা, খুব আনন্দের সহিত, অলংকার চুরির বিবরণ তাহাকে বলিতে লাগিল, – যেন খুব একটা আমোদের ব্যাপার ঘটিয়াছে। চোর যে অর্ধেক অলংকার নিতে পারে নাই, সেই জন্য সে স্বামীর নিকট দঃখ প্রকাশ করিল। ধনদোস বলিল, “তোমার আমি-আমার বৃদ্ধি এখনও গেল না। প্রভুর কতু প্রভু, নিতেছেন, তাতে আবার তুমি পাশ ফিরিয়া তাঁহাকে সাহায্য করিতে গেলে কেন? এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড যিনি চালাইতেছেন, এই অলংকারগুলি খুলিয়া নিতে কি তোমার সাহায্যের তাঁর প্রয়োজন ছিল? আমার দেহ' 'আমার অলংকার' এই জ্ঞান এখনও রহিয়াছে বলিয়া তোমার অর্ধেক বন্ধন কাটিল না।" 

শিষ্যগণ ভাবিয়াছিলেন, মূল্যবান অলংকার চুরি হওয়াতে ইহারা কতই না দুঃখ পাইবেন; কিন্তু ইহাদের বিপরীত আচরণে তাঁহারা স্তম্ভিত হইলেন। তাঁহারা ফিরিয়া আসিলে, গরুদের সকল শিষ্যকে ডাকাইয়া আনিলেন এবং ভক্ত দম্পতির আচরণের বিষয় আলোচনা করিতে লাগিলেন। এই অব্রাহ্মণ গৃহস্থ দম্পতির ত্যাগ, বৈরাগ্য ও গর্ভক্তি এবং ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী হইয়াও তাঁহাদের সামান্য কাপড় নিয়া কলহ এবং গল্পের কার্যে সংশয়ের কথা আলোচনা করিয়া শিযাগণ অতিশয় লজ্জিত হইলেন। আচার্যদেব যে সর্বজ্ঞ ও পরম করুণাময়, তাহা বুঝিতে পারিয়া, তাঁহার চরণে পড়িয়া, সকলে বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন।

(৫)

শ্রীসম্প্রদায়

আচার্য' রামানন্দজ প্রবর্তিত সম্প্রদায়ে, ভগবান্ নাররাণ রূপে উপাসিত। নারায়ণের শক্তি শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মীদেবীর নামে এই সম্প্রদায় শ্রীসম্প্রদায় নামে পরিচিত।

সমগ্র ভারতে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের ফলে, একটি প্রকাণ্ড সম্প্রদায় গঠিত হইল। আচার্যদেব ও তাঁহার শিষ্যগণ সকলেই বৃদ্ধ হইয়া পড়িতেছেন। তাহাদের অবর্তমানে এই বৃহৎ সম্প্রদায়ে ঐক্য রক্ষা কঠিন হইবে; আর প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের আক্রমণ হইতে বৈষ্ণব মত রক্ষা করিতে হইলে, অসাধারণ মনীষাসম্পন্ন লোকের প্রয়োজন। যামু নাচার্যের ন্যায়, আচার্য" রামানন্দজও ভগবানের নিকট উপযন্ত লোক প্রেরণের জন্য আকুল প্রার্থনা জানাইলেন। কিছুদিন পরে, করেশের দুইটি পত্র ও গোবিন্দের ভাই বালগোবিন্দের একটি পত্রে জন্মিল। আচার্য জানিতে পারিলেন, ইহারা সম্প্রদায় রক্ষার জন্য ভগবৎ প্রেরিত পুরুষ। শৈশবেই তিনি ইহাদিগকে দীক্ষিত করিলেন এবং করেশের দাই পাত্রের নাম রাখিলেন পরাশর ও বেদব্যাস এবং বালগোবিন্দের পাত্রের নাম হইল পরাঙ্কুশ-পূর্ণোচার্য।

শিশুকাল হইতেই, বালক তিনটি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিতে থাকিল। পরাশরের বয়স যখন চারি বৎসর মাত্র, তখন সে একদিন রাস্তায় ধুলো-খেলা করিতেছিল। সেই সময় দেখা গেল, ঢাক ঢোল বাজাইয়া একদল লোক আসিতেছে। নগরের লোক কৌতূহলী হইয়া টিয়া আসাতে, রাজ- পথে বেশ জনতা হইল। শুনা গেল, জনৈক পণ্ডিত উত্তর ভারতের সকল পণ্ডিতকে পরাস্ত করিয়া সর্বজ্ঞ নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। তিনি এখন রামানুজের সহিত বিচার করিতে আসিয়াছেন। তাহার সঙ্গে, গরুর গাড়িতে বোঝাই করা অনেক পথি ও অনেক শিষ্য। বালক, লোকের মুখে 'সর্বজ্ঞ’ কথাটার অর্থ নিল, 'যিনি সবই জানেন'। পণ্ডিত পালকী চড়িয়া নিকটে আসিলে, পরাশর এক মঠো ফুলা হাতে লইয়া ভিড়ের ফাঁকে, তাঁহার নিকট- বর্তী হইয়া, ধলা মঠা দেখাইয়া বলিল, “মহাশয়, আপনি তো সবই জানেন ; বলনে দেখি, আমার হাতে কয়টা বালি আছে ?” ভিড় ঠেলিয়া পাল কাঁ ধাঁরে ধীরে চলিতেছিল; সর্বজ্ঞ আমোদ ছলে বালকের সঙ্গে দুই একটি কথা বলিয়া বুঝিলেন, ইহা শিখানো কথা নহে, বালকটি সত্য সত্যই অসামান্য প্রতিভাশালী। তিনি তাহার পরিচয় নিয়া জানিলেন, সে রামানন্দজের শিষ্যের সন্তান। এই সামান্য ঘটনায় পণ্ডিতের মনে বিশেষ পরিবর্তন উপস্থিত হইল। তিনি আচার্য'কে বিচারে পরাজিত করিবার দুর্বাসনা ত্যাগ করিয়া, জ্ঞান লাভের জন্য তাঁহার শিষ্য হইলেন।

এইরূপে নিতাই বালক তিনটি এমন সক্ষম বৃদ্ধির পরিচয় দিতে লাগিল যে, বৈষ্ণবসমাজ তাহাদিগকে ভবিষ্য নেতা রূপে অতি শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতে লাগিলেন।



RJKB

RJKB stands for Raja Jnana Karma Bhakti. In this blogger site, you will get many more life building thoughts which will increase your Spiritual Power. So join this blog & start your Spiritual Journey. আর জে কে বি মানে রাজ জ্ঞান কর্ম ভক্তি। এই ব্লগার সাইটে, আপনি আরও অনেক জীবন গঠনের চিন্তা পাবেন যা আপনার আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করবে। সুতরাং এই ব্লগে যোগ দিন এবং আপনার আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করুন।

Post a Comment

Previous Post Next Post