পর্ব-৩গ
সমাজ-সংস্কারের প্রণালী
বিনম্র হিন্দুজাতি ও হিন্দু সভ্যতার উদ্দেশ্যে অজস্র গালিবর্ষণ করিয়া হাজার হাজার বক্তৃতা দেওয়া হইয়াছে এবং ঝুড়ি ঝুড়ি গ্রন্থ প্রকাশ করা হইয়াছে। কিন্তু তাহাতে কার্যতঃ কোনই সুফল হয় নাই। ইহার কারণ অবশ্য খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন নয়। ঐ গালিবর্ষণ করার কদর্য রীতিই এই বিফলতার জন্য দায়ী। বস্তুতঃ, নিন্দাবাদে কোন প্রকার হিতসাধন হইতে পারে না।
আমাদের সমাজে প্রচলিত অত্যন্ত কুসংস্কারপূর্ণ এবং অযৌক্তিক ব্যবস্থাগুলিকেও গালি দিতে যাইও না; কারণ, অতীতে ঐগুলি অবশ্যই কিছু না কিছু মঙ্গল সাধন করিয়াছে। সর্বদা মনে রাখিও যে, পৃথিবীতে এমন আর কোন দেশ নাই—যেখানকার রীতিনীতির লক্ষ্য ও আদর্শ ভারতের অপেক্ষা বাস্তবিকই উন্নত। এমন কি, যে-সব সামাজিক বিধান বর্তমানে একেবারে অনিষ্টকর বলিয়া মনে হইতেছে, উহারাও একদা প্রভৃত জীবনপ্রদ শক্তির উৎস ছিল। তাই আজ যদি উহাদিগকে বর্জন করিতেই হয়, তবে অবজ্ঞাভরে করিতে যাইও না; বরং এককালে এই জাতির সংরক্ষণে উহাদের অপূর্ব অবদান স্মরণ করিয়া কৃতজ্ঞ হৃদয়ে উহাদিগকে বিদায়-অভিনন্দন জানাইও।
জবরদস্তি সমাজ-সংস্কারে আমার আস্থা নাই। আমার বিশ্বাস, স্বাভাবিক ক্রমোন্নতির প্রচেষ্টাই সঙ্গত। এরূপ দুঃসাহস আমার নাই যে, ভগবানের আসন দখল করিয়া সমাজকে হুকুম করিব—“এই পথে চলিতে হইবে, অন্য কোন পদ্মে নয়।” জাতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য অব্যাহত রাখিয়া ভারতীয় সমাজের পুষ্টিসাধন, ক্রমোন্নতি ও সম্প্রসারণই আমার লক্ষ্য। ব্যষ্টির মুক্তি যেমন নিজেরই উপর নির্ভর করে, অপর কিছুর উপর নয়, জাতির পক্ষেও ঠিক তাহাই। উন্নততর সমাজ-ব্যবস্থা গড়িয়া উঠার পূর্বে পুরাতন সংস্থাগুলি নষ্ট করিবার যে-কোন চেষ্টায় শুধু অনর্থই ঘটিবে। উন্নতি সর্বদাই আসে নিয়মিত মন্থর গতিতে। সুতরাং মানুষকে প্রথমে তাহার বর্তমান স্তর হইতে সন্তর্পণে এক ধাপ উপরে উন্নীত করা প্রয়োজন। ইহা বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, অধিকাংশ আধুনিক সংস্কার আন্দোলন শুধু পাশ্চাত্তা ভাব ও কর্মপদ্ধতির নির্বিবেক অনুকরণ। নিশ্চয়ই উহা ভারতে চলিতে পারে না। ভারতের সংস্কারকগণ সকলেই এক মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করিতেন যে, ধর্মই পৌরোহিত্য এবং দুর্নীতির ভয়াবহ কুফলগুলির জন্য সমী। তাই তাহারা ধর্মের অবিনশ্বর সৌধটিকে ধূলিসাৎ করিতে যাইতেন; কিন্তু এই হঠকারী প্রচেষ্টার পরিণামে আসিত শুধু ব্যর্থতা।
সমাজের মূলে গিয়া সেখানে আগুন ধরাইয়া দিতে হইবে। আর দেখিতে হইবে যাহাতে সেই অগ্নি উপরের স্তরগুলি ভেদ করিয়া যাবতীয় আবর্জনা ভস্মীভূত করিতে পারে। বস্তুতঃ, তখনই হইবে এক সংহত ভারতীয় জাতির অভ্যুত্থান। আমার মনে হয়, ইহাই সমাজের আমূল সংস্কার। সমাজের যাবতীয় ব্যাধি শুধু দাবাইয়া রাখিলে চলিবে না, উহাদের মূলোৎপাটন করা প্রয়োজন। ইহাই আমার মতে সমাজের যথার্থ চিকিৎসা-পদ্ধতি।
সমাজের অন্তর্নিহিত অধ্যাত্মশক্তিই প্রতিফলিত হয় সামাজিক রীতিনীতির সুষ্ঠু পরিবর্তনে। ঐ আধ্যাত্মিক শক্তি সতেজ ও সুসম্বদ্ধ হইলে সমাজ-শরীরে তদনুযায়ী অনবদ্য রূপান্তর দেখা যায়। বস্তুতঃ আত্মিক উন্নয়ন ব্যতীত কোন প্রকার সংস্কার সম্ভব হয় না। এই তথ্য মনে রাখিয়া তথাকথিত ভুয়া সমাজ- সংস্কারে অযথা হস্তক্ষেপ করিতে যাইও না।
আমাদের সমাজ-ব্যবস্থার যুগোপযোগী শোধনের অবশ্য প্রয়োজন আছে। পূর্ব পূর্ব মুখে মনীষীরা কালোপযোগী প্রগতির নুতন পন্থা আবিষ্কার করিতেন, এবং ঐগুলি তখনকার রাজশক্তি রাষ্ট্রীয় বিধানে পরিণত করিয়া সমাজে প্রচলিত করিত। এইভাবে ভারতীয় সমাজ আগাইয়া চলিত। বর্তমান কালে ঐরূপ অগ্রগতির জন্য যুগোপযোগী সংস্কার ঘটাইতে হইলে প্রথমেই গড়ি তুলিতে হইবে সমাজের নিয়ন্ত্রণ-শক্তি। বর্তমানে দেশীয় রাজশক্তির অভাবে সমাজ-পরিচালনের দায়িত্ব জনগণের উপরই ন্যস্ত। তাই যতদিন না ভারতের জনগণ শিক্ষিত হয়, যতদিন না তাহারা তাহাদের প্রয়োজন সম্বন্ধে সচেতন হইয়া নিজেদের সমস্যা মিটাইবার সামর্থ্য লাভ করিতে পারে, ততদিন আমাদের অপেক্ষা করিতে হইবে। কল্পনাপ্রসূত অবাস্তব কতকগুলি সংস্কারের উদ্দেশ্যে শক্তিক্ষয় না করিয়া আমাদের সর্বাঙ্গে গড়িয়া তুলিতে হইবে সমাজ- নিয়ত্তা এক সার্বভৌম বিধান পরিষদ, অর্থাৎ ভারতের জনগণকে এমনভাবে শিক্ষিত করিতে হইবে যাহাতে তাহারা জাতির সমস্যাগুলির সমাধান নিজেরাই করিতে সক্ষম হয়। যতদিন না এরূপ করা যায়, ততদিন কল্পিত সংস্কারগুলি স্বপ্নরাজ্যেই থাকিয়া যাইবে। গণশক্তিই গণমুক্তি ঘটাইবে, ইহাই আধুনিক যুগের নববিধান। অবশ্য ইহা বাস্তবে রূপায়িত করা সময়সাপেক্ষ বিশেষতঃ ভারতে—যেহেতু এদেশে সমাজ অতীতে চিরদিনই রাজশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইয়াছে।
যদি যথার্থ সংস্কারক হইতে চাও তবে তিনটি শর্ত পূরণ করিতে হইবে। সর্বাগ্রে সহানুভূতি; তুমি কি তোমার ভাইদের জন্য সত্যই দরদ বোধ কর? জগতে এত দুঃখকষ্ট, এত অজ্ঞান, এত কুসংস্কার রহিয়াছে, ইহা বাস্তবিকই কি তুমি অনুভব কর? সত্যই কি তুমি বোধ কর যে, মানুষমাত্রেই তোমার ভাই? তোমার সমগ্র সত্তা দিয়া কি এইরূপ উদগ্র সমবেদনা অনুভব করিতেছ? তোমার রক্তের সহিত মিশিয়া শিরা-উপশিরায়, স্নায়ু-প্রবাহের মধ্যে কি উহা চলাচল করিতেছে? এই তীব্র সহানুভূতিতে কি তুমি ভরপুর হইয়া গিয়াছ? যদি এরূপ হইয়া থাক, তবে মনে রাখিও, ইহা সংস্কারসাধনের মাত্র প্রথম ধাপ। তারপর দেখিতে হইবে, প্রতিকারের কোন সন্ধান পাইয়াছ কিনা। প্রাচীন। ধারণাগুলি হয়ত কুসংস্কারবহুল; কিন্তু ঐ কুসংস্কারের আবর্জনা স্তূপের মধ্যে এবং আশেপাশে সোনার তালের মত বহু চিরন্তন সত্য আছে। ঐ আবর্জনা সাফ করিয়া উজ্জ্বল শোষিত সুবর্ণগুগুলি রক্ষা করিবার কোন উপায় আবিষ্কার করিয়াছ কি? সর্বশেষ দেখিতে হইবে, তোমার উদ্দেশ্যটি যথার্থ মহৎ কিনা। অর্থ, মান, যশ, প্রতিষ্ঠা প্রভৃতিতে প্রলুব্ধ হইয়া তুমি সমাজ সংস্কারে ব্রতী হও নাই ত?
-------------------------------------------------------------------
Part- 3C
Method of social reform
Thousands of speeches have been given and heaps of books have been published heaping insults on the humble Hindu people and Hindu civilization. But there was practically no benefit. The reason for this is not difficult to find. The bad habit of swearing is responsible for this failure. In fact, cynicism can do no good.
Let's not even insult the highly superstitious and irrational systems prevailing in our society; Because they must have done some good in the past. Always remember that there is no other country in the world whose customs aims and ideals are practically superior to those of India. In fact, social institutions that today seem downright pernicious were once sources of such life-giving energy. So if you have to reject them today, don't do it with contempt; Rather remember their wonderful contribution to the preservation of this nation and congratulate them with a grateful heart.
I have no faith in forced social reform. I believe, natural progression efforts are in order. I do not have the courage to occupy the seat of God and command the society - "This path must be followed and not on any other lotus." My aim is to nurture, improve and expand the Indian society by continuing the characteristics of the national culture. As the liberation of the individual depends on himself and not on anything else, the same is true for the nation. Any attempt to destroy the old institutions before a better social order is formed will only lead to failure. Improvement always comes at a steady slow pace. So man first needs to be raised a step higher in surrender from his present level. It is a matter of great regret that most of the modern reform movements are mere imitations of western ideas and practices. Surely it cannot work in India. The reformers of India all harbored a fatal misconception that religion was synonymous with the terrible evils of priesthood and corruption. So they used to destroy the imperishable monument of religion; But this stubborn effort only resulted in failure.
We have to go to the root of the society and start the fire there. And it has to be seen how the fire can penetrate the upper layers and burn all the garbage. In fact, only then will there be an upheaval of a united Indian nation. I think this is a radical reform of society. All the ills of the society cannot be suppressed, they need to be eradicated. This, in my opinion, is the proper treatment of society.
The inherent spirituality of the society is reflected in the systematic change of social norms. When that spiritual energy is refreshed and well-organized, a remarkable transformation can be seen in the society-body accordingly. In fact, no reform is possible without spiritual development. Keep this information in mind and don't interfere unnecessarily with the so-called fake social reforms.
Our social system needs to be modernized. In the Far East, thinkers discovered new methods of progress, and these were then converted into state laws by the then monarchies and introduced into the society. This is how Indian society moves forward. In the present time, if there is to be an age-appropriate reform for such progress, the controlling power of the society will have to be developed first. At present, in the absence of a native monarchy, the responsibility of social management is vested in the people. So until the people of India are educated, until they become aware of their needs and are able to solve their own problems, we have to wait. Instead of wasting energy on a few fanciful and unrealistic reforms, we have to build a sovereign legislature of social-determination, i.e. educate the people of India in such a way that they are able to solve the problems of the nation by themselves. Until this is done, the imagined reforms will remain in the realm of dreams. Mass power will bring about mass liberation, this is the new law of the modern age. Of course, this will take time to materialize, especially in India—since society has historically been dominated by monarchies.
If you want to be a true reformer, you have to fulfill three conditions. Empathy is paramount; Do you really feel compassion for your brothers? There is so much suffering, so much ignorance, so much superstition in the world, do you really feel it? Do you really feel that people are your brothers? Do you feel such intense compassion with your whole being? Is it moving with your blood in the veins, veins and nerves? Are you filled with this intense sympathy? If this is the case, remember that this is only the first step in reformation. Then you will have to see if you have found any remedy. ancient Concepts may be superstitious; But in and around that rubbish heap of superstition there are as many eternal truths as gold bars. Have you discovered a way to clean up that mess and save the bright absorbed gold? The last thing to see is whether your purpose is truly noble. Have you not become a devotee of social reform after being lured by money, status, age, establishment etc.?