রামামুজ চরিত
তৃতীয় অধ্যায়- দ্বিতীয় পর্ব ( ৫-৮)
দাশরথি
দাশরথি কালীন ও মহাপণ্ডিত আর, সম্ভবতঃ আচার্য দেবের ভাগিনেয় বলিয়া একট, অভিমানী ছিলেন। তিনি 'গীতার শেষ কথা’* জানিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিলে, আচার্য তাঁহাকে গোষ্ঠিপূর্ণের নিকট পাঠাইলেন। তিনি গোষ্ঠিপূর্ণের নিকট যাইয়া প্রায় ছয় মাস তাঁহার সেবা করিলেন।
একদিন গোষ্ঠিপূর্ণে তাঁহাকে বলিলেন যে, গুরুর নিকট হইতেই এই বিষয় তাঁহার শিক্ষা করা উচিত। দাশরথি ফিরিয়া আসিয়া আচার্যদেবকে ইহা জানাইলেন। এই সময় গর্, মহাপর্ণের কন্যা অত্তলা আসিয়া রামানন্দজকে বলিলেন যে, তাঁহার শ্বশুরবাড়িতে সংসারের সমদেয় কাজ তাঁহাকে একাকী করিতে হয়, কাজকর্মে'র ত্রুটি হইলে শাড়ী তাঁহাকে গালমন্দ করেন এবং বলেন, যদি বড়মানুষী করিতে হয়, তবে বাপের বাড়ি হইতে পাচক অত্য আনিতে হইবে। বালিকা বলিতে লাগিল, “বাবাকে আমি এই কথা বলিয়া- ছিলাম, তিনি বলিলেন, আমি কি করিতে পারি, মা, তুমি তোমার রামাজে দাদাকে এই বিষয় জানাও।" অন্তলার এই সব কথা নয়, আচার্যদেব দাশরথির দিকে তাকাইলেন। দাশরথি গুরুর মনোভাব বুঝিতে পারিয়া, পাচক রূপে অন্তলার সঙ্গে তাঁহার শ্বশুরবাড়িতে চলিয়া গেলেন। অগুলার শ্বশুর শাশুড়ী ও অন্যান্য সকলে তাঁহাকে পাচক-জ্ঞানে অবজ্ঞা করিলেও, তিনি অভিমান সম্পর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া, কর্তব্য পালন করিয়া যাইতে লাগিলেন।
একদিন এক বাক্তির সঙ্গে শাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁহার একটা তর্ক উপস্থিত হয়। তাঁহার অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাইয়া উপস্থিত সকলে আশ্চর্যান্বিত হইলেন। তখন তাঁহারা সমধান নিয়া জানিলেন, ইনি একজন সর্বত্যাগী মহা- পুরুষ এবং আচার্যের ভাগিনেয়া। এই কথা শুনিয়া অত্তুলার শশুর শাশুড়ী অত্যন্ত ভীত হইয়া দাশরথির পায়ে পড়িয়া ক্ষমা চাহিলেন এবং আচার্যের অনুমতি লইয়া তাঁহাকে পাচকের কাজ হইতে মুক্ত করিলেন। দাশরথির সকল অভিমান দূর হইয়াছে বুঝিতে পারিয়া, আচার্য দেব তাঁহাকে এইবার শ্রীমদ্ ভগবদ্ গীতার চরম জ্ঞান উপদেশ করিয়া কতার্থ করিলেন।
(৬)
পূজারী
শ্রীরামে আচার্য রামাজে এখন সর্বেসর্বা। ঠাকরেসেবার দিকে তাঁহার দৃষ্টি তীক্ষ, এক-তিল এদিক ওদিক হইবার উপায় নাই। সুতরাং পূজারী- গণকে সর্বদা শঙ্কিত থাকিতে হইত। প্রধান পূজারী ঠাকুরের ক্ষমতা ও প্রভাব অনেকটা খর্ব হইয়া গেল। আচার্যগণ পুরাতন নিয়ম ষোল আনা মানিলেও, অনেক আচার ব্যবহার তাঁহারা নতন ছাঁচে ঢালিয়া কালোপযোগী করিয়া নেন। বৃদ্ধ ও মূর্খেরা তাহা একেবারেই সহ্য করিতে পারে না। এই- সব নানা কারণে, মন্দিরের প্রধান পূজারী মনে-প্রাণে আচার্যদেবের মহা শহ হইয়া উঠিল। সে তাঁহার অনিষ্ট সাধন করিবার জন্য ছিদ্র অন্বেষণ করিতে লাগিল ।
আচার্য প্রত্যহ সাত বাড়িতে ভিক্ষা করিতেন। পূজারী একদিন ভিক্ষা দিবার ছলে, তাঁহাকে বিষ মিশ্রিত অন্ন খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিল। কিন্তু রামানুজে ভিক্ষা নিতে আসিলে, পূজারীর ভক্তিমতী স্ত্রী কৌশলে তাঁহাকে এই কথা জানাইয়া দিল। রামাজে ইহাতে বড়ই ব্যথিত হইলেন ; তিনি ভাবিলেন, অবশ্যই তাঁহার কোনও দোষ আছে, নতুবা ঠাকরের সেবকের মনে তাঁহার প্রতি এইরূপ হিংসার ভাব উপস্থিত হইবে কেন? তিনি অত্যন্ত ক্ষরে-মনে কাবেরী তীরে যাইয়া অনাহারে ভগবানের ধ্যানে মগ্ন হইলেন।
আমরা নিজের দোষ-এটি কিছুতেই দেখিতে চাই না, সর্বদা পরকেই দোষী মনে করি। কিন্তু মহাপুরুষগণ পরের দোষ না দেখিয়া, নিজেকে সর্বদা দোষী দেখিতে চেষ্টা করেন ।
মাঠে ফিরিতে আচার্যে'র বিলম্ব দেখিয়া, পূর্ণজতে জিতে শিক্ষাগত কাবের তটে আসিয়া তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন। গোষ্ঠিপূর্ণে ও এই সংবাদ পাইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। গরুকে দেখিয়া রামানাজ নদী-তীরে তপ্ত বালুকার উপর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়া পড়িয়া রহিলেন। গোষ্ঠিপপূর্ণ সেই দিকে মনোযোগ না দিয়া রামানাজের বিলম্বের কারণ ইত্যাদি সব কথা অন্য দের নিকট হইতে শুনিতে লাগিলেন। আচার্যদেব তপ্ত বালকোর উপর পড়িয়া কষ্ট পাইতেছেন, অথচ গোষ্ঠিপূর্ণে তাঁহাকে উঠিতে আদেশ করিতেছেন না দেখিয়া, প্রণতার্তিহর নামক আচার্যের জনৈক শিষ্য বলিয়া উঠিলেন, “আপনি কি এই গরম বালিতে ফেলিয়া ইহাকে মারিয়া ফেলিতে চান?” প্রণতার্তিহর কথাটা কর্কশ ভাবেই বলিলেন গোষ্ঠিপূর্ণে কিন্তু রামানাজের গুরু-ভক্তি দেখিয়া আনন্দিত হইলেন। তিনি রামানাজকে সস্নেহে উঠাইয়া বলিলেন, “তুমি আর ভিক্ষায় বাহির হইও না তোমার এই শিষ্যটি তোমার জন্য রন্ধন করিবে। এ সত্য সত্যই তোমায় ভালবাসে।”
পূজারী যখন দেখিল তাহার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল না, তখন সে অন্য উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। একদিন আচার্যদেব সন্ধ্যারতির পর চরণামৃত গ্রহণ করিতে গেলেন। পূজারী পূর্ব হইতেই প্রস্তুত ছিল; সে এই সুযোগে, চরণামত দিবার ছলে, তাঁহাকে ভয়ানক কালকট বিষ-মিশ্রিত य দিল। আচার্যদেব ভক্তি সহকারে, সরল মনে, তাহা পান করিলেন। ক্ষণকাল মধ্যেই বিষের ক্রিয়া দেখা গেল। আচার্য হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন এই সংবাদে নগরবাসিগণ উদবিগ্ন হইয়া উঠিল। তাঁহার যথোচিত চিকিৎসার ব্যবস্থা হইল এবং তাঁহাকে প্রফুল্ল রাখিবার জন্য সারা-রাত্র ধরিয়া ভগবানের নাম- কীর্তন চলিল। পরদিন সকালে তিনি প্রায় সুস্থ হইয়া উঠিলেন।
পূজারীর দকার্যের কথা আর গোপন রহিল না। বাহির হওয়া তাহার পক্ষে বিপজ্জনক হইয়া উঠিল। বৈষ্ণবগণ সকল বিষয়ে এখন ঘর হইতে ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া থাকেন তাহা না হইলে, পূজারীর জীবন রক্ষা করা কঠিন হইত। পূজারী যখন দেখিল, এমন ভয়ানক বিষ খাইয়াও 'আচার্য' বাঁচিয়া রহিলেন, তখন সে পাপের আশংকায় ও মানুষের নির্যাতনের ভয়ে পাগলের ন্যায় আসিয়া আচার্যে'র পায়ে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। দয়ার অবতার আচার্যদেব, “আর এরূপ করিও না” বলিয়া তাহাকে ক্ষমা করিলেন।
(৭)
যজ্ঞমূর্তি
ধর্ম সংস্কারের জন্য, মহাপর,ষগণ যে সব উপায় অবলম্বন করেন, বিষয়া- সক্ত লোক, তাঁহাদের অনুকরণে, সেই সব কার্যের ভান করিয়া সাংসারিক উদ্দেশ্য সাধন করে ; চিরকালই এইরূপে দেখা যাইতেছে। ভগবান শঙ্করাচার্য অসৎপথগামী লোককে ধর্ম পথে আনিবার জন্য, শাস্ত্রবিচার সহায়ে সনাতন ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে মান-যশ লাভের জন্য, পাণ্ডিত্যাভিমানী ব্যক্তিরা সন্ন্যাসী সাজিয়া, দিগবিজয় করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। তাঁহারা কেহ কেহ অনেক শিষ্য ও পুস্তক সঙ্গে লইয়া, দেশে দেশে যাইয়া, পণ্ডিতগণকে তর্ক করিতে আহ্বান করিতেন এবং তর্কশাস্ত্রের রীতি অনুসারে কথার ফাঁক বাহির করিয়া একে অন্যকে অপদস্থ করিবার চেষ্টা করিতেন। ইহাতে না থাকিত ভগবানের কথা, না ছিল সত্য নির্ণয়ের আকাঙ্ক্ষা। চরিত্রের পবিত্রতা ও কঠোর সাধনা দ্বারা আত্মোপলি বা ভগবান্ লাভই যে সন্ন্যাসের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাহা লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল।
সেই কালে যজ্ঞমমূর্তি নামক জনৈক সন্ন্যাসী, পূর্বোক্ত-রূপে তর্কযুদ্ধে করিতে শ্রীরঙ্গমে আসিয়া উপস্থিত হন। বলা বাহুল্য, তিনি মহা পণ্ডিত ও তার্কিক ছিলেন। তিনি আচার্যকে তর্ক প্রতিযোগিতায় আহহ্বান করেন। কয়েক দিন ধরিয়া ধর্মশাস্ত্র নিয়া উভয়ে তুমুল তর্কযুদ্ধে রত হন। অবশেষে, তার্কিকের কাট কৌশলে, রামানাজ প্রায় নিরন্তর হইলেন।
ভগবান্ লাভ হইলে মানব-স্বভাবের সর্ব-প্রকার দুর্বলতা দূর হইয়া যায় এবং জীবন আনন্দময় হইয়া উঠে। আর শুধু, পাণ্ডিত্যে মানষের মনে অহঙ্কার ও ঈর্ষাদ্বেষ বৃদ্ধি হয়। তাহার ফলে, মানুষ নিজকে বড় দুর্বল, অসহায় ও নিরানন্দ বোধ করে। রামানুজে ভগবানকে পাইয়াছেন—যাঁহাকে শাস্ত্রজ্ঞানে বা তর্ক-যুক্তি দ্বারা পাওয়া যায় না। তাই, যজ্ঞমমূর্তি নানাপ্রকার বাক্যাড়ম্বর ও তর্ক-ঘটা প্রকাশ করিলেও আচার্যের বিরাট ব্যক্তিত্বের তুলনায় তাহা যে কত তুচ্ছ, এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে তাহার জ্ঞান যে কত অল্প, তাহা তিনি পদে পদে সস্পষ্ট রূপেই অনভব করিলেন। অবশেষে, অনুভব-হীন শাস্ত্রজ্ঞান ও যুক্তি-তর্ক, প্রত্যক্ষ অনুভবে বলীয়ান সিদ্ধান্তের নিকট, নীরব হইতে বাধ্য হইল। আচার্যদেব কৃপা করিয়া, পশ্চিতের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করিয়া দিলেন। তাহার পাণ্ডিত্যা- ভিমান দূর হইল জ্ঞান লাভের জন্য ব্যাকলে হইয়া তিনি আচার্যের শিষ্যর গ্রহণ করিলেন। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হইয়া তাঁহার নাম হইল দেবরাজ মনি।
(৮)
গোবিন্দের মহত্ব
এই সময়ে, আচার্যদেব কিছুকাল নির্জনে তপস্যা করিবার জন্য মাতুল শ্রীশৈলপূর্ণের নিকট গিয়া বাস করেন। তাঁহার মাসতুত ভাই গোবিন্দ শৈলপেের্ণর নিকট হইতে দীক্ষা গ্রহণ করেন। গুরু-সেবা জ্ঞান-লাভের প্রধান উপায় জানিয়া, তিনি, দিবানিশি, নিরলস ভাবে, গর সেবায় নিতে থাকিতেন।
একদিন রামানুজ দেখিলেন, গুরের বিছানা পাতিয়া গোবিন্দ তাহাতে গড়াগড়ি দিতেছেন। গুরুর বিছানায় ও আসুনে শোয়া বা বসা মহাপাপ। এমন অন্যায় কাজ কেন করেন জিজ্ঞাসিত হইয়া তিনি উত্তর দিলেন, “ইহা মহাপাপ আমি জানি, কিন্তু বিছানা কোথাও কাচকান বা অসমান থাকিলে গবর কষ্ট হইতে পারে; তাই, আমি নিজে বিছানা পরীক্ষা করিয়া দেখি। গুদের মুখের জন্য, আমি পাপের ফলভোগ করিতে প্রস্তুত।" পরে প্রতি তাঁহার এত ভালবাসা দেখিয়া রামানজে অত্যন্ত সুখী হইলেন।
আর একদিন, রামানুজ দেখিলেন, গোবিন্দ একটি প্রকাণ্ড সাপের মুখে হাত দিয়া কি করিতেছেন। কৌতূহলী হইয়া রামানুজে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলিলেন, "সাপটা মুখে কাঁটা ফাটিয়া ভারী কষ্ট পাইতেছিল, কাঁটাটা তুলিয়া দিলাম।” যেন সাপটা তাঁহার কত বন্ধ ! যোগাঁরা বলেন, যোগ- সাধনা দ্বারা কাহারও মন হইতে হিংসা একেবারে চলিয়া গেলে, তাঁহার নিকটে, হিংস্র জর মনেও হিংসার ভাব উঠিতে পারে না। গোবিন্দের অপূর্ব চরিত্রের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া আচার্যদেব, শৈলপুর্ণের নিকট চাহিয়া, তাঁহাকে শ্রীরামে লইয়া গেলেন। শ্রীরামে ফিরিয়া আচার্যদের অনেক গ্রন্থ রচনা করিলেন। তিনি নিজে নিজের মত লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। তাই আমরা বিশদ্ধে রামানন্দজ মত' এখনও জানিতে পারি। তাহা না হইলে, লোকে নানা প্রকার কুসংস্কার জড়াইয়া, তাঁহার মত বিকৃত করিয়া ফেলিত।